ঋণাদান কী? যাজ্ঞবল্ক্যকে অনুসরন করে ঋণাদান ও বৃদ্ধি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা কর।
যাজ্ঞবল্ক্যকে অনুসরন করে ঋণাদান ও বৃদ্ধি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা
উ:- স্মৃতি শাস্ত্রের বিধানসমূহ রাজদন্ডের ছত্রছায়ায় পরিপুষ্ট ছিল। বর্তমান যুগে রাজতন্ত্রের অবসানের ফলে বর্ণাশ্রম প্রথার অবলুপ্তি ঘটেছে। তথাপি ভারতীয় দণ্ডবিধির উৎস রূপে আজও মনুর মনুসংহিতা ও যাজ্ঞবল্ক্যের যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার বিধানই স্বীকৃত। বর্তমানে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে গঠিত ভারত রাষ্ট্রের রাজার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন লোকসভার সদস্যগণ। রাষ্ট্রের সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে সংবিধানের। বিচার ও প্রশাসনিক কার্যের সুবিধার জন্য এই দুটোকে পৃথক করা হয়েছে। আইন প্রয়োগের দায়িত্ব ভার স্বতন্ত্র রূপে বিচার বিভাগের উপর থাকে। স্মৃতি যুগে রাজারা প্রাডবিবাকাদির সাহায্যে বিচার করতেন। স্বভাবতই মানব জীবনে অর্থনৈতিক কারবার প্রসঙ্গে ঋণাদান বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঋণাদান কী?
যোগীশ্বর যাজ্ঞবল্ক্য রচিত যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার ব্যবহার নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে ১৮ প্রকার ব্যবহার পদের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো ঋণাদান।
ঋণ দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটি অর্থাৎ ঋণাদান পদ্ধতিটি প্রাচীন ভারতীয় রীতি ছিল। এই রীতি অনুসারে সবন্ধক ও অবন্ধক উভয় প্রকার ঋণের স্বীকৃত ছিল। প্রাচীন ধর্ম শাস্ত্রগন এতদ্ বিষয়ক নিয়মগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
ঋন ও আদান এই দুটি শব্দ নিয়ে ঋণাদান পদটি গঠিত। ঋণাদান কথাটির অর্থ হল প্রদত্ত ঋণের আদায় অর্থাৎ উত্তমর্ণ যতপ্রকারে অধমর্ণকে ঋন দেন সেসবের আদায়। এজন্য দন্ডও আলোচিত হয়েছে। বিচারের সাহায্য ব্যতিরেকে প্রাচীনকালে এমন কি বৈদিক যুগেও উত্তমর্ণ বিভিন্ন উপায়ে অধমর্ণের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারতেন।
ঋণাদান বিষয়ে সাতপ্রকার বিচার্য বিষয়
নারদ স্মৃতি গ্রন্থে আচার্য নারদ ঋণাদান বিষয়ে সাতপ্রকার বিচার্য বিষয় উল্লেখ করেছেন-
“ঋণং দেয়ম্ অদেয়শ্চ যেন যত্র যথা চ যৎ।
দানগ্রহণধর্মাভ্যাম্ ঋণাদানমিতি স্মৃতম্।।”
এই শ্লোকের প্রথমার্ধে অর্ধমর্ণের পাঁচ প্রকার ঋণ বিধি বলা হয়েছে-
- i) কোন প্রকার ঋণ শোধযোগ্য
- ii) কোন প্রকার ঋণ শোধ অযোগ্য
- iii) কে ঋণ পরিশোধ করবে
- iv)কোন সময়ের ঋণ শোধ করতে হবে
- v) ঋণ শোধের প্রকার বা পদ্ধতি।
ঋণাদানের প্রকারভেদ
আবার উত্তমর্ণের ক্ষেত্রে ঋণাদান বিষয় দু প্রকার। যথা- আদান বিধি ও দানবিধি।
“উত্তমর্ণে দানবিধিঃ আধানবিধিশ্চেতি দ্বিবিধম্।”
নারদ এসব কথা স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে ব্যক্তি দ্বারা যে স্থানে যে সময়ে এবং যেভাবে ঋণাদান ও গ্রহণের নিয়ম অনুযায়ী ঋণ দেয় বা অদেয় হয় তাকে ঋণাদান বলে।
যাজ্ঞবল্ক্যকে অনুসরন করে বৃদ্ধি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা
আচার্য যাজ্ঞবল্ক্য ঋণাদান প্রকরণের প্রথমেই ঋণের উপর বৃদ্ধি ও সুদের হার নিয়ে আলোচনা করেছেন। ঋণ দুই প্রকার। যথা সবন্ধক ও অবন্ধক। সবন্ধক ঋণের সুদের হার কেমন তা সবিস্তারে বর্ণনা করতে গিয়ে গ্রন্থাগার বলেছেন-
“অশীতিভাগো বৃদ্ধিঃ স্যান্ মাসি মাসি সবন্ধকে।
বর্ণক্রমাচ্ছতং দ্বিত্রিচতুষ্পঞ্চকমন্যথা।।”
সবন্ধক ঋণের ক্ষেত্রে সুদ হবে প্রতি মাসে ৮০ ভাগের একভাগ। অবন্ধক ঋণের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র যথাযথ দুই তিন চার ও পাঁচ শতাংশ সুদ দেবে।
যেসব বণিক টাকা ধার নিয়ে অধিক লাভের আশায় গভীর অরণ্যে ব্যবসার জন্য চলে যায় তারা মাসের শতকরা ১০ ভাগ সুদ দেবে এবং সমুদ্র ব্যবসায়ীরা শতকরা কুড়ি ভাগ সুদ দেবে। সকল জাতির মানুষই নিজ অঙ্গীভূত সুদ দেবে-
“কান্তারগাস্তু দশকং সামুদ্রাবিংশকং শতম্।
দদ্যুর্বা স্বকৃতাং বৃদ্ধিং সর্বে সর্বাসু জাতিষু।।”
আচার্য নারদের মতে বৃদ্ধির প্রকারভেদ
আচার্য নারদের মতে বৃদ্ধি চার প্রকারভেদ । যথা-
- i) কালিকা বা প্রতিমাসের প্রদেয় বৃদ্ধি
- ii) কায়িকা বা প্রতিদিবসে বৃদ্ধি
- iii) কারিতা বা উত্তমর্ণ বা অধমর্ণের পারস্পরিকভাবে স্থিরকৃত বৃদ্ধি।
- iv) চক্রবৃদ্ধি বা বৃদ্ধির হার।
“বৃদ্ধেবৃদ্ধি চক্রবৃদ্ধি প্রতিমাসং তু কালিকা
ইচ্ছাকৃতা কারিতা স্যাৎ কায়িকায় কর্মণা।।”
যে স্ত্রী পশু বন্ধক রাখে সে ওই পশুর বাচ্চাটিকে সুদরূপে দেবে। কোনো দ্রব্য দীর্ঘকাল বন্ধক রাখা হলে তৈলাদির ক্ষেত্রে সুদ হবে প্রকৃত মূল্যের আটগুন এবং বস্ত্র, ধান্য ও সুবর্ণের ক্ষেত্রে সুদ হবে দ্রব্যের মূল্যের যথাক্রমে চারগুন, তিনগুন ও দ্বিগুন –
“সন্ততিস্তু পশুস্ত্রীনাং রসস্যাষ্টগুণা পরা।
বস্ত্রধান্যহিরণ্যানাং চতুস্ত্রিদ্বিগুণা পরা।।”
ঋণাদানের ব্যাপারে যাজ্ঞবল্ক্য অপেক্ষা মনুর মনোভাব বেশি কঠোর ছিল। ঋণাদান সম্পর্কে মনু বলেছেন-
“ধর্মেন ব্যবহারেণ ছলেনাচরিতেন চ।
প্রযুক্তং সাধয়েদর্থং পঞ্চমেন বলেন বা।।”
ধর্ম,ব্যবহার, ছল,আচরণ ও বলপ্রয়োগ- এই পাঁচটি উপায়ের দ্বারা উত্তমমর্ণ নিজ প্রযুক্ত ঋণ আদায়ের চেষ্টা করবেন।
যাজ্ঞবল্ক্য বলেন- ওই সব উপায়ে উত্তমবর্ন অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে রাজা অধমর্নকে দিয়ে ওই ঋণ শোধ করাবেন এবং দন্ড রূপে শতকরা ১০ ভাগ গ্রহণ করবেন। উত্তমর্ণও অর্থ পেয়ে সেই অর্থের শতকরা পাঁচ ভাগ বিচারের খরচরূপে রাজাকে দেবেন-
“রাজ্ঞাঅধমর্ণিকো দাপ্যঃ সাধিতাদ্ দশকং শতম্।
পঞ্চকং চ শতং দাপ্যঃ প্রাপ্তার্থোত্থ্যত্তমর্ণিকঃ।।”
অধমর্ণ হীন জাতির ও ধনহীন হলে উত্তমর্ণ তাকে কর্মে নিযুক্ত করে ঋণ পরিশোধ করাবে। কিন্তু অধমর্ণ ধনহীন ব্রাহ্মণ হলে তার কাছ থেকে যথাসম্ভব ধীরে ধীরে ঋণকৃত অর্থ আদায় করা হবে-
“হীনজাতিং পরিক্ষীণম্ ঋণার্থং কর্ম কারয়েৎ।
ব্রাহ্মণস্তু পরিক্ষীণঃ শনৈর্দাপ্যো যথোদয়ম্।।”
দেয় ঋণ কোন সময় কে শোধ করবে তা বলতে গিয়ে আচার্য যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন-
“অবিভক্তৈঃ কুটুম্বার্থে যদ্ ঋণং তু কৃতং ভবেৎ।
দদ্যুস্তদ্ রিকথিনঃ প্রেতে প্রোষিতে বা কুটুম্বিনি।।”
একান্নবর্তী সংসারের গৃহস্বামী একা বা অনেক সদস্য মিলে যদি সাংসারিক খরচ যোগানোর জন্য ঋণ নিয়ে থাকে তবে সেই কুটুম্বী অর্থাৎ গৃহস্বামী ঋণ পরিশোধ করবে। কিন্তু তার মৃত্যু হলে বা দেশান্তরিত হলে তার সম্পত্তির ভোগকারীরা সকলে মিলে ঋণ শোধ করবে-
“পিতরি প্রোষিতে প্রেতে ব্যসনাভিপ্লুতেঅপি বা।
পুত্রপৌত্রৈঃ ঋণং দেয়ং নিহ্নবে সাক্ষি ভাবিতম্।।”
পিতা স্বকৃত ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশ যাত্রা করলে, মারা গেলে বা ব্যাসনাসক্ত হলে পুত্র ও পৌত্রগন সে ঋণ শোধ করবে। সেই ঋণ তারা অস্বীকার করলে উত্তমর্ণ সাক্ষী দ্বারা যদি তা প্রমাণ করে দেয় তাহলে তারা সেই ঋণ পরিশোধ করবে।
পিতার ঋণ সাধারণত পুত্র শোধ করে। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন মদ্যপান, স্ত্রীসম্ভোগ, জুয়াখেলা, রাজদন্ড রূপে নির্ধারিত অদত্ত পৈত্রিক ঋণ, কন্যাদানের শুল্ক বা পণরূপে অদত্ত পৈত্রিক ঋণ পুত্র শোধ করবে না।-
“সুরাকামদ্যূতকৃতং দণ্ডশুল্কাবশিষ্টকম্।
বৃথাদানং তথৈবেহ পুত্রো দদ্যান্ন পৈত্রিকম্।।”
গোয়ালা, মদ্যব্যবসায়ী, নাট্যজীবী, রজক ও ব্যাধের পত্নীরা ঋণ করলে সেই ঋণ শোধ করতে তাদের স্বামীরা বাধ্য থাকবে। কারণ এদের জীবিকা নির্বাহ হয় তাদের স্ত্রীগণের সহায়তায়-
“গোপশৌণ্ডিকশৈলূষরজকব্যাধঘোষিতাম্।
ঋণং দদ্যাৎ পতিস্তেষাং যস্মাদ্ বৃত্তিস্তদাশ্রয়া।।”
আবার প্রবাসকালে বা মুমূর্ষাবস্থায় স্বামী কৃত ঋণ স্ত্রী স্বীকার করলে সেই ঋণ এবং স্বামীও স্ত্রী একসঙ্গে ঋণ করলে সেই ঋণ শোধ করতে বাধ্য থাকবে। এছাড়া স্বামীর অন্য কোন ঋণ দিতে স্ত্রী বাধ্য নয়-
” প্রতিপন্নং স্ত্রিয়া দেয়ং পত্যা বা সহ যৎকৃতম্।
স্বয়ং কৃতং বা যদ্ ঋণং নান্যং স্ত্রীদাতুমর্হতি।।”
উপসংহার
উপসংহারে বলা যায় যোগীশ্বর যাজ্ঞবল্ক্যকৃত ঋণাদান প্রকরণটি প্রাচীন ভারতের অর্থনীতি ও সমাজনীতির সমীক্ষায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান ভারতের ঋণগ্রহণ ও শোধ করার পদ্ধতির সঙ্গে সেকালের ঋণ আদান-প্রদান পদ্ধতির বহু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন আধি, প্রতিভূ ও বৃদ্ধি এই তিনটি বিষয়ে এ যুগের ঋণ দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে অপরিহার্য। কে কোন পরিস্থিতিতে ঋণ শোধ করবে এবং কারা কোন ঋণ শোধ করবে এবং কারা কোন ঋণ শোধ করবে না এসকল বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত বিধান গুলি আমাদের পাঠককূলের হৃদয়গ্রাহী চিত্তকে বিস্মৃত ও বিশেষভাবে শ্রদ্ধান্বিত করে।