বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্- ব্যাখ্যা কর। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস বানভট্ট |
বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ – ব্যাখ্যা
উঃ- বানভট্ট সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এক প্রাজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। তিনি সংস্কৃত গদ্যকাব্যের স্বার্থক রূপকার। কাদম্বরী শব্দের অর্থ সূরা অর্থাৎ মদিরা ।
মদিরার মাদকতা যেমন মানুষকে উন্মত্ত করে তলে, তেমনি কাদম্বরী কাব্যের রসসুধা পান করে সারস্বত সমাজ তেমনি আহার নিদ্রা ভুলে আনন্দে হিভোর হয়ে পড়েন-
” কাদম্বরীরসজ্ঞানামাআবোঅপি ন রোচতে’।
কবিপুত্র ভূষনভট্ট বলেছেন-
“কাদম্বরীরসভরেন সমস্ত এব সত্তো ন কিঞ্চিদপি চেতয়তে জনোঅয়ম্”।
বানভট্টের কাব্যামৃতপানে পরিতৃপ্ত ভারতীয় বিগদ্ধ সমাজ যুগ যুগান্তর ধরে তার সার্বভৌম প্রতিষ্ঠার কথা স্বীকার করে অজস্র প্রশস্তি গেয়েছেন।
বানভট্ট হলেন কবিদের কবি বর্ণনার জগতে রাজাধিরাজ সাহিত্য রস সমৃদ্ধ গদ্যেব স্রষ্টা।
“গদ্যং কবীনাং নিকষং বদন্তি”
অর্থাৎ গদ্য যে কবি প্রতিভার বিচারে কষ্টিপাথর রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে তাও বানভট্টের রচনারই পরিপ্রেক্ষিতে।
সর্বকালের মহাকবির আসন অলংকৃত করে আছেন তিনি বিদগ্ধ মুখমণ্ডনে ধর্মদাস বানভট্টের সার্থক প্রশস্তি গেয়েছেন-
“রুচিরাস্বরবর্ণপদা রসভাববতী জগন্মনোহারিণি।
তৎ কিং তরুনী নহি নহি বানী বানস্য মধুরশীলস্য।।”
বর্ণনার অত্যাশ্চর্য শক্তি, ভাষার ঐশ্বর্য, শব্দার্থের প্রাচুর্য, কল্পনার মাধুর্য ভাবের গভীরতা পাঠক চিত্তকে এক অলৌকিক আনন্দরসে আপ্লুত করে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
” ভাবের সেই রাজকীয় অজস্রতার উপযোগী ভাষা সংস্কৃত ভাষা ।
সেই স্বভাব বিপুল ভাষা কাদম্বরীতে পুর্ণবর্ষার নদীর মতো আবর্তে তরঙ্গে গর্জনে আলোকচ্ছটায় বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আবার কাদম্বরী কাব্য কে একটি চিত্রশালার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন-
” চিত্রপুরী জেমন সংলগ্ন একটি ছবির চারিদিকে প্রচুর কারুকার্য বিশিষ্ট বহুবিস্তৃত ভাষার সোনার ফ্রেম দেওয়া। ফ্রেম সমেত সেই ছবিগুলির সৌন্দর্য আস্বাদনে যে বঞ্চিত সে দুর্ভাগ্য।(প্রাচীন সাহিত্য কাদম্বরী)।
বিশ্বকবির এই উক্তি প্রমাণ করে বানভট্টের প্রতিটি চিত্রকলা বর্ণনা হলো মহাকবির অনবদ্য শিল্পসুষমার বহিঃপ্রকাশ। এই শিল্প সুষমার আধার রূপে মহাকবি গ্রহণ করেছেন প্রাকৃতিক জগতের অসংখ্য সামগ্রী জথা প্রভাত সন্ধ্যা সূর্যচন্দ্রোদয বিন্ধ্যাটবী পুষ্পসরোবর অচ্ছদসরোবর নদ-নদী সন্দির কুটির আশ্রম লতাপাতা তরুরাজি পশুপক্ষী ইত্যাদি। এগুলি সবই বাণভট্টের লোকোত্তর সঞ্জীবনী প্রতিভা স্পর্শে জীবন্ত হয়ে উঠেছে আরো রয়েছে শাস্ত্রীয় জ্ঞানের বিশাল জগত যথা ধর্ম শাস্ত্র নীতিশাস্ত্র শব্দ শাস্ত্র কাম শাস্ত্র বেদান্ত বৌদ্ধ প্রভৃতি দর্শন শাস্ত্র।
নিত্য বাদ্য সংগীত বিদ্যা প্রভৃতি। তাছাড়া রয়েছে এ ছন্দ অলংকার ধ্বনিব্যঞ্জনা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বানপ্রতিভা স্পর্শ করেছে এবং যাকে স্পর্শ করেছে তাকে স্পর্শ মনির মত অসাধারণ করে তোলে।
তাই একশ্রেণীর সমালোচক বলেছেন –
” বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ ‘।
অর্থাৎ জগতে সমুদায় সামগ্রিই বানভট্টের প্রতিভার দ্বারা উচ্ছিষ্ট বা স্পৃষ্ট।
কোন ব্যক্তির খাওয়ার পর ভজন পাত্রে ভুক্ত্বারশিষ্ট সকল খাদ্য থাকে তাকে বলা হয উচ্ছিষ্ট। এই প্রবাদ বাক্যটি প্রকৃত অর্থ হলো- জ্ঞানের জগতে এমন কোন বিষয় নেই যা বানভট্টের প্রতিভার স্পর্শ লাভ করে উপমান সামগ্রী রূপে তার সাহিত্যের স্থান পায়নি।
সুতরাং জ্ঞানের জগতে যা কিছু বিষয় সামগ্রী রয়েছে স্মৃতি ও সাহিত্য শাস্ত্রে পুরানে ও ইতিহাসে জ্যোতিষ ও ভেষজশাস্ত্রে এমনকি লোকাচার ও সময় দর্শন প্রভৃতি সবক্ষেত্রেই বানভট্টের ছিল অগাধ প্রবেশাধিকার।তার প্রমাণ কাদম্বরী ও হর্ষচরিতে ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে। বানভট্ট তার গদ্যরচনায় এইসব শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে বহু পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ করেছেন তাঁর দুইগদ্যকাব্যে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে সাংখ্য দর্শন থেকে পুরুষ ও প্রকৃতি মহত্বত্ত্ব।
বৌদ্ধ দর্শনের প্রতীত্যসমুৎপাদ,জৈন দর্শনে আত্মবাদ, স্মৃতিশাস্ত্রের অযমর্ষন। যোগ দর্শনের প্রাণায়াম,ব্রহ্মাসন, বেদান্ত দর্শনের মায়াবাদ ঈশ্বরবাদ ন্যায় দর্শনের অবয়ব প্রভৃতি পারিভাষিক শব্দের উল্লেখ প্রমাণ করেছেন যে এই সকল শাস্ত্রে বানভট্টের অসাধারণ অভিনিবেশ ছিল এবং বানভট্টের সর্বব্যাপ্ত প্রতিভার স্পর্শে এই সকল শাস্ত্রের জ্ঞান ভান্ডার উন্মত্ত হয়েছিল তাঁর কাব্যে ।
জাগতিক বা শাস্ত্রীয় এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলনা। যা বানভট্টের নব নব উন্মেষ শালিনী প্রতিভার স্পর্শ লাভ করেনি। সর্বোপরি শুকনাসোপদেশ অংশে মহাকবি বানভট্ট লোকচরিত্র ও রাজাদের চরিত্র বিষয় যে সুগভীর এবং সুব্যাপক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন।
আজন্ম প্রভুত্ব অভিনব যৌবন এবং অপ্রতিরূপ কিভাবে যৌবনকালে মানুষকে বিভ্রান্ত করে বিপদগামী করে সে সম্পর্কে যে ব্যাপক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ হাজির করেছেন কাদম্বরী কাব্য এবং রাজলক্ষ্মী চরিত্র সম্পর্কে যে নিবিড় জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন পরবর্তীকালে কোন কবি বা লেখক এসব ক্ষেত্রে বানভট্টের সমতুল্য রূপে বিবেচিত হতে পারেনি।
সবকিছুকেই বানভট্ট তার কাব্যের উপমান সামগ্রী রূপে গ্রহণ করেছেন কোন কিছুই অন্য কবিদের বর্ণনার জন্য অবশিষ্ট রাখেননি। বর্ণনীয় উপমান সামগ্রীর জগতের সবকিছুই বানভট্ট তাঁর প্রতিভার আলোকে উদ্ভাসিত করে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর কাব্যে।
এছাড়া বানভট্ট তার কাব্যে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণীর সামাজিক মানুষ তাদের জীবিকা সমসাময়িক সামাজিক রীতি-নীতি পোশাক-পরিচ্ছদ অলংকার ও সৌন্দর্য সম্পাদক সামগ্রী গৃহ্য সংস্কার ও উৎসব অনুষ্ঠান খেলাধুলা ও আমোদ প্রমোদ নগর জীবন ও গ্রাম জীবন, ছাত্রদের শিক্ষনীয় বিষয প্রভৃতি। এমনকি অংকন ও মূর্তি নির্মাণ বিদ্যা,দারুকর্ম বা কাঠের খোদাই এর কাজ, শকুনিশাস্ত্র যন্ত্র প্রয়োগ, রতিশাস্ত্র প্রভৃতি অসংখ্য পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায় বানভট্টের কাব্যদুটিতে।
শব্দটিব্র প্রস্তুতিতেও বানভট্টের সমতুল্য অপর কোন কবিকে দেখা যায় না বানভট্টের গদ্যে যেরূপ সূক্ষ নিরীক্ষন শক্তি, চমৎকার বর্ননা প্রণালী তথা কল্পনাপ্রসূত বহু অলৌকিক অর্থের ভাবনা বিশেষভাবে উপলব্ধ হয় রস এবং অলংকারের যে মধুর মিলন ভাষা ও ভাবের যে পারস্পরিক সম্পর্ক কল্পনাও বর্ণনার যে অনুকুলসং ঘটনা প্রাচীন কাহিনীর সঙ্গে আধুনিক সংবেদনশীলতার যে অপূর্ব সমন্বয় কাদম্বরী কাব্যের উপলব্ধ তেমন আর অন্য কোন কবির কাব্যে তা পাওয়া যায় না।তাই রসিক হৃদয়ে কাদম্বরী কাব্য নিরন্তন বর্ষণ করে চলেছে। অমৃতনিঃস্যন্দী রসধারা।
বাণভট্টের রচনার কাব্যগুনও অসাধারণ। উক্তির বৈচিত্র্য,ভাবের গাম্ভীর্য, কল্পনার বৈচিত্র্য, গদ্যভাষার কমনীয়তা, ওজস্বিতা, সঞ্জুল ভাবব্যঞ্জনা, মধুরপদবিন্যাস, কোথাও দীর্ঘ সমাজের ভারে ভারাক্রান্ত গদ্য, আবার কোথাও একেবারে সমাসহীন ছোট ছোট বাক্য রচনা রীতির এই বিচিত্রতা বানভট্টের প্রতিভার অসাধারণোত্বরই পরিচায়ক।
কবির চিত্তভূমি যেন এক রঙিন কল্পলোক, আর সেই কল্পনার বহু বিচিত্র রঙে, অনন্ত বৈচিত্র্যে কাদম্বরী হয়ে উঠেছে অতিদ্বয়া কথা। বানের রচনা বিষয়ে বিদ্যাসাগরের বক্তব্য – তার বর্ণনা সকল করুন মাধুর্য অর্থের গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ।রচনা মধুর,কোমল, সলিল ও প্রগাঢ়। রচনা বিশেষ প্রশংসা এই বানভট্ট যেসকল শব্দবিন্যাস করেছেন তার একটিও পরিবর্তন সহ নহে।
পরিশেষে বক্তব্য এই যে, বানভট্ট শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হয়ে উদাসীন ও উৎচ্ছৃঙ্খল ভাবে নানা দেশ-বিদেশ পাহাড় পর্বত অরন্য ঘুরেছেন প্রাণভরে। দেখেছেন সমাজের বিভিন্ন মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা পদ্ধতি মিশেছেন গায়ক নর্তক লিপিকার চিত্রকর ঐন্দ্রজালিক প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে। এই গভীর সান্নিধ্যই কবিকে কাদম্বরী কাব্য রচনার রসদ যুগিয়েছে। প্রতিটি বর্ণনায় যেন আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে বানভট্টের লেখনীর সঞ্জীবনী স্পর্শে।তাই এখানে এমন কোন রূপ নেই এমন কোন রং নেই এমন কোন কল্পনা নেই এমন কোন চিত্র নেই যা রস সমৃদ্ধ হয়ে উঠেনি। এমনকি ত্রিভুবন সপ্তলোক জন্ম-জন্মান্তরের অমনুভূত সংস্কার সবকিছুই ধরা দিয়েছে কবির কল্পনায় কাদম্বরী কাব্যে।
তাই রসজ্ঞ সমালোচক যথার্থই বলেছেন-
” বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ ”।
আরো পড়ুন – কাদম্বরী সম্পর্কে পোস্টগুলি
- কাদম্বরী: শুকনাসোপদেশঃ( সংস্কৃত ব্যাখ্যা)
- কাদম্বরী: সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- ‘কাদম্বরী’ কথা না আখ্যায়িকা
- কাদম্বরী: চন্দ্রাপীড়ের প্রতি শুকনাসের উপাদেশাবলী
- বানভট্টকে অনুসরন করে মহাশ্বেতার রূপ বর্ণনা কর
- বাণভট্ট রচিত কাদম্বরী কথা না আখ্যায়িকা আলোচনা কর
- বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ – ব্যাখ্যা কর
- বাণোছিষ্টং জগৎ সর্বম্- কাদম্বরী পাঠ্যাংশের অনুসারে বর্ননা