বাক্যপদীয়কার কটি প্রমাণ স্বীকার করেন? এই প্রমাণ বিষয়ে গ্রন্থকারের অভিমত ব্যক্ত কর।
বাক্যপদীয় প্রমাণ বিষয়ে গ্রন্থকারের অভিমত
বাক্যপদীয়কার কটি প্রমাণ স্বীকার করেন?
বাক্যপদীয়কার ভর্তৃহরি পাঁচটি প্রমাণ স্বীকার করেন?
ভর্তৃহরি স্বীকৃত প্রমাণসমূহ:-
বাক্যপদীয় গ্রন্থে আচার্য ভর্তৃহরি পাঁচটি প্রমাণ স্বীকার করেছেন। সেগুলি হল- প্রত্যক্ষ, অনুমান বা তর্ক, আগম বা শব্দ, অভ্যাস ও অদৃষ্ট।
প্রমাণ বিষয়ে গ্রন্থকারের (ভর্তৃহরি) অভিমত:-
গ্রন্থাকার পাঁচটি প্রমাণ বিষয়ে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সেগুলি সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হল-
i) আগম প্রমাণ:-
ভর্তৃহরি প্রথমে আগম সিদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, কোন কোন ব্যক্তির মতে সাধু শব্দ হল ধর্মের অঙ্গ। যদি এই মত মেনে নেওয়া হয় তবে প্রশ্ন উঠে যে, সাধু শব্দের ব্যবহারের জন্য ব্যাকরণাগমের কি প্রয়োজন? তর্ক বা অনুমানের সাহায্যেই শব্দের সাধুত্ব নির্ণয় সম্ভব। আর যুক্তির দ্বারা যেখানে সাধুত্ব নিরূপণ অসম্ভব, সেখানে ঋষিগণের আর্ষজ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব। এইভাবে যাঁরা সাধু শব্দ ব্যবস্থা এবং তম্মুলক ধর্ম নিয়ম বিষয়ে ব্যাকরণাগমের উপযোগিতা অস্বীকার করতে চান তাঁদের মত নিরাকরণের এর উদ্দেশ্যে আগমের উপযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে ভর্তৃহরি বলেছেন-
“ন চাগমাদৃতে ধর্মস্তর্কেণ ব্যবতিষ্ঠতে।
ঋষীণামপি যজজ্ঞানং তদপ্যাগমপূর্বকম্।।” (বাক্যপদীয় ১/৩০)
ধর্ম বা পূণ্য -পাপ কেবলমাত্র অবিচ্ছিন্ন পরম্পরাগত আগমের দ্বারাই নির্ণয় করা সম্ভব। আগমবিরোধী স্বমণীষাকল্পিত যুক্তি যা শুষ্ক তর্করূপে পরিচিত, তার দ্বারা ধর্মব্যবস্থা আদৌ সম্ভব নয়। দৃষ্টবিষয়েও যুক্তির দ্বারা বস্তুর নির্ণয় সম্ভব নয়। যেমন- বহ্নি দমন করে কেন? জলের শৈত্য কি কারণে ঘটে? এর উত্তরে যুক্তিবাদী যারা তারাও শেষ পর্যন্ত কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন না। উদাহরণস্বরূপ অগ্নিষ্টোম যাগের দ্বারা স্বর্গ প্রাপ্ত হলে যাগের সঙ্গে স্বর্গের সাধ্যসাধনভাব প্রত্যক্ষের দ্বারা গৃহীত হয় না এবং ব্যাপ্তি
নির্ণয় না হলে তর্কের প্রসারও সম্ভব নয়। কিন্তু যজ্ঞাদির ধর্মসাধনত্ব ইন্দ্রিয়গোচর না হলেও যেহেতু এটা অবিচ্ছিন্ন গুরু- শিষ্য ক্রমাগত আগমের দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে, সেহেতু শিষ্যগণ তার প্রামাণ্য স্বীকার করে থাকেন।
আবার যেহেতু অবস্থাভেদ, দেশভেদ, কালভেদবশতঃ পদার্থসমূহের শক্তি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, সেহেতু অনুমানের সাহায্যে তাদের অর্থাৎ পদার্থের সেই সেই শক্তির নিশ্চয় অতীব দুর্লভ-
” অবস্থা দেশ কালানাং ভেদাদ্ ভিন্নাসু শক্তিষু।
ভাবানামনুমানেন প্রসিদ্ধি রতিদুর্লভা।।”(বাক্যপদীয় ১/৩২)
অর্থাৎ তর্ক বা অনুমানের সাহায্যে অতীন্দ্রিয় ধর্মাদিবিষয় তো দূরের কথা, ইন্দ্রিয়গোচর লৌকিকভাব বা পদার্থ রাজির স্বরূপ বা শক্তি সম্বন্ধে কোনোরূপ নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান লাভ করাও সম্ভব নয়। অতএব তর্ক বা অনুমান ক্ষেত্রবিশেষে অসমর্থ প্রতিপাদিত হওয়ায় ঐসব স্থলে আগমের উপযোগিতা স্বীকার করতে হয়।
ii) অভ্যাস প্রমাণ:-
এইভাবে আগমকে অন্যতম প্রমাণ রূপে প্রতিষ্ঠা করার পর ভর্তৃহরি নিম্নোক্ত কারিকার দ্বারা অভ্যাসকে অতিরিক্ত প্রমাণ রূপে স্বীকার করেছেন-
“পরেষামসমাখ্যেয়মভ্যসাদেব জায়তে।
মণিরূপ্যাদিবিজ্ঞানং তদ্বিদাং নানুমানিকম্।।”(বাক্যপদীয় ১/৩৫)
অর্থাৎ রত্নপরীক্ষক যখন সুবর্ণাদির উৎকর্ষ বা বিশুদ্ধির তারতম্য নিরূপণ করে থাকেন, তখন তার চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের দ্বারা সম্ভব হয় না, এটা অবশ্যই স্বীকার্য। কেননা রত্নাদির উৎকর্ষ উৎপাদক ধর্মসমূহ অতি সূক্ষ্ম, অতীন্দ্রিয়। আর প্রত্যক্ষ প্রমাণ এস্থলে কুণ্ঠশক্তি বলে তন্মূলক অনুমানও রত্নাদির উৎকর্ষ অবধারণে অসমর্থ। আগম প্রমাণের দ্বারাও এই জ্ঞান সম্ভব নয়। এই জ্ঞানলাভের উপায় সম্বন্ধে ভর্তৃহরি বলেছেন-
“অভ্যাসাদেব জায়তে”
– বারংবার মণিরূপ্যাদির প্রত্যক্ষ করতে করতে তাদের উৎকর্ষ – তারতম্য রত্নপরীক্ষকের নিকট উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
iii) অদৃষ্ট প্রমাণ:-
ভর্তৃহরি অদৃষ্টকেও প্রমাণরূপে স্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে কারিকাটি হল-
“প্রত্যক্ষমনুমানঞ্চ ব্যতিক্রম্য ব্যবস্থিতাঃ।
পিতৃরক্ষঃ পিশাচানাং কর্মজা এব সিদ্ধয়ঃ।।”
(বাক্যপদীয় ১/৩৬)
অর্থাৎ পিতৃগণ, রাক্ষসগণ এবং পিশাচগণের যে সকল সিদ্ধি সেগুলি প্রত্যক্ষ এবং অনুমানের অতীত এবং কেবলমাত্র কর্ম বা অদৃষ্ট হতেই উদ্ভূত। সুতরাং প্রমাণ রূপে অদৃষ্ট স্বীকার্য।
তাছাড়া যোগিগণের চিত্ত তপস্যার দ্বারা ‘দগ্ধকিল্বিষ’, ফলে তাদের চিত্ত সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের দ্বারা অনুপপ্লুত (কালুষ্যরহিত) হওয়ায় অনাবৃত জ্ঞান তাদের চিত্তে আবির্ভূত হতে পারে। সেই অবস্থায় যেসকল পদার্থের জ্ঞান আমাদের ন্যায় পুরুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা অনায়াসে সেই সকল পদার্থের স্বরূপ জ্ঞাত হতে পারেন। তাদের সেই জ্ঞান আমাদের লৌকিক প্রত্যক্ষের ন্যায় সাক্ষাৎকারাত্মক প্রত্যক্ষ হতে কোনোও ভেদ নেই। তাদের এই অতীন্দ্রিয় বস্তুর মানস সাক্ষাৎকারের ক্ষমতা অদৃষ্ট বা কর্মজন্য। সুতরাং অদৃশ্যকেও আর্ষপ্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রমাণ বা নিমিত্তরূপে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
[iv) প্রত্যক্ষ প্রমাণ :-
যোগিগণের অতিত ও অনাগত বিষয়ের জ্ঞান প্রসঙ্গে ভর্তৃহরি অলৌকিক প্রত্যক্ষের উল্লেখ করেছেন। আবার তিনি জানিয়েছেন যে যোগিগণের অলৌকিক প্রত্যক্ষ জ্ঞান অস্মদাদি পুরুষের লৌকিক প্রত্যক্ষের মতই একপ্রকার প্রত্যক্ষ জ্ঞান। সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে, ভর্তৃহরি লৌকিক এবং অলৌকিক প্রত্যক্ষ উল্লেখ করে প্রমাণ রূপে প্রত্যক্ষকে স্বীকার করেছেন।
v) অনুমান প্রমাণ :-
অনুমান প্রমাণটিও ভর্তৃহরির অনুমত। কারণ, তিনি আগম প্রমাণের প্রতিষ্ঠাকল্পে ক্ষেত্রবিশেষে অনুমান বা তর্কের ন্যূন্যতা দেখিয়েছেন, কিন্তু প্রতিষেধ করেননি। সুতরাং ভর্তৃহরির মতে, অনুমানও একটি স্বীকার্যপ্রমাণ।