কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসরণে ‘সন্নিধাতৃনিচয়কর্ম’ অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর বিবৃতি করো।or, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সন্নিধাতার কর্তব্য লেখ।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে ‘সন্নিধাতৃনিচয়কর্ম’ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সন্নিধাতার কর্তব্য
ভূমিকা :- আচার্য কৌটিল্য বিরচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের অধ্যক্ষপ্রচার নামক দ্বিতীয় অধিকরণের ২৩ তম প্রকরণের পঞ্চম অধ্যায়টির নাম সন্নিধাতৃনিচয়কর্ম। প্রথম, মধ্যম ও অবর- এই তিন শ্রেণীর অধ্যক্ষের মধ্যে সন্নিধাতা প্রথম শ্রেণীর অন্তর্গত। সম্+নি-√ধা+তৃচ্ প্রত্যয় করে সন্নিধাতৃ পদটি নিষ্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ যিনি সম্যকরূপে নিধান করেন। সন্নিধাতা কিভাবে বিভিন্ন দ্রব্য সংগ্রহ করবেন ও তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন- এ বিষয়ে কৌটিল্য এই অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
সন্নিধাতার কোষ গৃহাদি নির্মাণ:-
এই অধ্যায়ের প্রথমেই বলা হয়েছে-
“সন্নিধাতা কোষগৃহং পণ্যগৃহং কোষ্ঠাগারং কুপ্যগৃহম্ আয়ুধাগারং বন্ধনাগারং কারয়েৎ।”
অর্থাৎ সন্নিধাতা রাজকোষ, রাজকীয় পণ্য বা বিক্রেয় দ্রব্যের রক্ষণস্থান, বিভিন্ন শস্য ও খাদ্যদ্রব্যের নিচয়স্থান, বনজ সম্পদ রাখার উপযোগী গৃহ, অস্তশালা ও বন্ধনাগার নির্মাণ করাতেন। এগুলি কিভাবে নির্মাণ করাতেন তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
ক) কোষগৃহ নির্মাণ:-
সন্নিধাতা এমনভাবে একটি চারকোনা পুকুর খনন করাতেন, যেখানে কোন জলকাদা থাকত না। সেই পুকুরের তলদেশ ও পার্শ্বদেশ বড়ো বড়ো শিলা দিয়ে বাঁধানো হত। সেখানে মাটির তলায় একটি গৃহ নির্মাণ করা হত। এই গৃহের উপরিতল, মধ্যমতল ও অধস্তন তল পাথর ও ইঁট দিয়ে বাঁধানো হত। সেই কোষগৃহের একটিমাত্র দরজা থাকত যেটিকে দেবমূর্তির সাহায্যে আড়াল করে রাখা হত, যাতে প্রবেশপথ সাহায্যে বোঝা না যায়। এই কোষগৃহটি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হত।
আপৎকালীন অবস্থার কথা চিন্তা করে রাজাকে আর একটি কোষ গৃহ তৈরি করাতে হত। জনপদের প্রান্তে কোন নির্জন স্থানে সমাজে পরিত্যক্ত, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামীদের দিয়ে গৃহনির্মাণ করানো হত। তা নির্মাণের পর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলে তারা আর কোষগৃহ সম্পর্কিত কোন তথ্য প্রকাশ করে ফেলতে পারত না।
খ) পণ্যগৃহ ও কোষ্ঠগৃহ নির্মাণ:-
সন্নিধাতা পাকা ইঁটের থামযুক্ত পরস্পর মুখোমুখি বক্ষ বিশিষ্ঠ একদ্বার বিশিষ্ট, অনেকগুলি কোষ্ঠ বা ঘরযুক্ত ও দুইপাশে খোলা স্তম্ভশোভিত অনিন্দযুক্ত পণ্যগৃহ ও কোষ্ঠাগার নির্মাণ করাতেন-
” পক্বেষ্টকাস্তম্ভং চতুঃশালমেকদ্বারমনেকস্থানতলং, বিবৃতস্তম্ভাপসারমুভয়তঃ পণ্যগৃহং কোষ্ঠাগারং চ। “
গ) কুপ্যগৃহ নির্মান:-
সন্নিধাতা বহু দীর্ঘ হল ঘর যুক্ত ও ছোট ছোট গৃহদ্বারা আবৃত ও প্রাচীরযুক্ত করে ভিতরে কুপ্যগৃহ নির্মাণ করাতেন-
” দীর্ঘ-বহুলশালং কক্ষাবৃত কুড্যমন্তঃ কুপ্যগৃহং।”
ঘ) আয়ুধাগার নির্মাণ:-
সন্নিধাতা কুপ্যগৃহের মতোই গঠন বিশিষ্ট গৃহকে ভূগর্ভস্থ গৃহযুদ্ধ করে আয়ুধাগার নির্মাণ করাতেন।
ঙ) বন্ধনাগার নির্মাণ:-
সন্নিধাতা বিচারকদের আদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের এবং সন্নিধাতা সর্মাহর্তা প্রভৃতি অধ্যক্ষের দ্বারা দন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য পৃথক পৃথক বন্ধনাগার নির্মাণ করাতেন। এই কারাগারে পুরুষ ও স্ত্রীলোকদের আস্থানের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকত এবং কারাগারে অপরাধীদের বাসগৃহ এমন ভাবে সুরক্ষিত থাকত যেন তারা সহজে পালিয়ে যেতে না পারে।
চ) সন্নিধাতা রত্নচন্দণাদি সংগ্রহ:-
কোষগৃহ প্রভৃতি ভবনে যে সমস্ত দ্রব্য রক্ষিত হত, সেগুলি সংগ্রহ করার দায়িত্ব ছিল সন্নিধাতার। যারা বংশপরম্পরায় কাজ করেছে এমন দক্ষ কারিগর ও কর্মকরদের সাহায্যে নতুন ও পুরানো বিবেচনা করে রত্ন, চন্দনাদি, বস্ত্রাদি,ফল্গুদ্রব্য, কাঠ ও চামড়া প্রভৃতি কুপ্য দ্রব্য সংগ্রহ করা হত। রাজকোষে বঞ্চনা করে নকল রত্ন প্রদান করলে দোষী ব্যাক্তিকে উত্তম সাহস দণ্ড দিতে হত। মূল্যবান কাঠ প্রভৃতি সার পদার্থের ক্ষেত্রে প্রতারনা করলে মধ্যম সাহসদণ্ড দিতে হত। আর ফল্গু ও কুপ্যদ্রব্য বঞ্চনা করলে যে মানের দ্রব্য দেওয়ার কথা সেরূপ একটি নতুন জিনিস দিতে হত এবং তার সবমূল্যের অর্থদণ্ড দিতে হত। মুদ্রার বিশুদ্ধতা পরীক্ষার জন্য সন্নিধাতা রূপদর্শকের সাহায্য নিতেন। তারা যেসকল মুদ্রাকে আসল বলতেন, সেগুলি সন্নিধাতা রাজকোষে প্রেরণের ব্যবস্থা করতেন।
জ) সন্নিধাতার অন্যান্য কর্ম:-
কোষগৃহাদি নির্মাণের পর সেগুলির জন্য প্রয়োজনীয় পরিখা, অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা প্রভৃতিও সন্নিধাতার কর্তব্যের মধ্যে ছিল। এছাড়াও জলের জন্য কূপ ও স্নানগৃহের ব্যবস্থা রাখা হত। বর্তমানযুগে আবহাওয়াবিদেরা যেমন বৃষ্টিপাত প্রভৃতির পরিমাণ মাপের, তখনকার দিনেও সেরকম বৃষ্টিপাতের পরিমাপ করা হত। এই ব্যবস্থাও সন্নিধাতাকে করতে হত। জনপদ ও নগর থেকে সংগৃহিত সর্বপ্রকার আয়ের হিসাব রাখাও ছিল সন্নিধাতার অন্যতম কর্তব্য।
ঝ) বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ আয়ের হিসাব:-
বাহ্য (জনপদ) ও আভ্যন্তর (অর্থাৎ নগর থেকে সংগৃহীত) আয় সম্পর্কেও সন্নিধাতাকে অভিহিত থাকতে হত। এ ব্যাপারে তাঁর এমন অভিজ্ঞতা থাকতে হবে যেন একবছরের পুরানো আয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলেও তিনি অনায়াসে তা বলে দিতে পারেন। ভান্ডাগারে রক্ষিত দ্রব্যাদির ব্যয় হওয়ার পর যা অবশিষ্ট আছে তার হিসাবও তিনি যেন প্রয়োজন রাজা বা উপযুক্ত ব্যাক্তির সামনে প্রকাশ করতে পারেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সন্নিধাতার কর্তব্য
সুতরাং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যেসমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীর পরিচয় পাই, তাদের মধ্যে সবথেকে গুরুত্ব ছিল সন্নিধাতার। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, রাজকোষ প্রভৃতি যে সমস্ত ভবন নির্মাণ ও বিভিন্ন দ্রব্য সংগ্রহের দায়িত্ব সন্নিধাতার উপর ন্যস্ত ছিল সেখানকার অধ্যক্ষগণও তাঁদের কাজের জন্য সন্নিধাতার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতেন।
- অর্থশাস্ত্র: ভূমিচ্ছিদ্রবিধান অধ্যায় অবলম্বনে কৃষির অযোগ্য ভূমির ব্যবহার
- অর্থশাস্ত্র: ‘সন্নিধাতৃনিচয়কর্ম’ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু