অশোকের অনুশাসন অনুসরনে অশোককথিত ধর্মের স্বরূপ আলোচনা কর। আভ্যন্তরীণ ধর্ম স্থাপনে অশোক কি কি উপায় গ্রহণ করেছিল, আলোচনা কর।
অশোকের অনুশাসন অনুসরনে অশোককথিত ধর্মের স্বরূপ আলোচনা কর
ভূমিকা:- অশোক ছিলেন একই সঙ্গে রাষ্ট্রনায়ক ও জননায়ক। রাষ্ট্রশাসনই তাঁর জীবনের শেষ কথা নয়, তাঁর সমাজ সংস্কার ও ধর্মসংস্কারের বাণী বিশ্ব ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। অশোকের মতো এত বড়ো মানবদরদী রাষ্ট্রনায়ক খুব কমই দেখা গেছে। তাঁর অভিলেখের মূল কথাই হল -ধর্মাচরনের দ্বারা মানুষের ইহলোক ও পারলৌকিক জীবনকে সুখী করে তোলা যায়। ধর্ম বলতে তিনি religion বা বিশেষ কোনও সাম্প্রদায়িক ধর্মকে বোঝাননি। যে নীতির অনুসরনে মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির মহত্তম বিকাশ সম্ভব হয়, তাকেই তিনি ধর্ম মনে করেছেন।
সারাবিশ্বে যে যুগে মানুষ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যকুল, রনবিজয়ী সম্রাটদের পদভারে মানুষের জীবন যখন পদদলিত তখন পৃথিবীর কাছে অশোক তুলে ধরলেন জাতি, বর্ণ ও ধর্মনির্বিশেষে মানুষের মধ্যে শান্তি ও মৈত্রীর বানী। এইভাবে অশোক তাঁর যুগের চেয়ে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের নির্মম হত্যালীলা সম্রাটের মনে শুধু ভাবান্তর আনেনি, তাঁর রাষ্ট্রচিন্তাতেও যুগান্তর এনেছিল। ধর্মবিজয়ের প্রবর্তন করে তিনি হয়ে ওঠেন বুদ্ধের মৈত্রীসাধনার উত্তরসাধক। তাঁর ধর্মের ভিত্তি ছিল চিরন্তন ও সর্বজনীন চারিত্রনীতি, যার অনুসরনে মানুষের জীবন হয়ে উঠতে পারে শুচি ও সুন্দর। এই ধর্মের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় অশোকের অভিলেখগুলি থেকে।
অশোক অনুশাসনে বর্ণিত ধর্মের স্বরূপ /আভ্যন্তরীন ধর্ম স্থাপনে অশোকের দ্বারা গৃহিত উপায়সমূহ:-
i) অনুসংযান:-
অনুসংযান শব্দটির অর্থ পর্যটন। মৌর্য সম্রাটদের মধ্যে অশোকেই প্রথম যিনি রাষ্ট্রের সর্বত্র পর্যটন সেরে প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ স্থাপনের চেষ্টা করেন। তাঁর পূর্ববর্তী সম্রাটেরা ছিলেন বিহার যাত্রার পক্ষপাতী।
অষ্টম মুখ্য গিরিশাসনে অশোক বলেছেন, অতীতে রাজারা বিহারযাত্রা করতেন, তাতে মৃগয়া এবং তার সঙ্গে নানা রকমের আমোদ-প্রমোদ হোত। কিন্তু দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা তাঁর অভিষেকের দশ বৎসর পর সম্বোন্ধিতে গেলেন এবং তখন থেকে তীর্থে তীর্থে ধর্ম যাত্রার সূচনা হল।
অশোক বলেছেন যে, এই ধর্মযাত্রার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ ও শ্রমনদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়, তাঁদের অর্থদান করা যায়। যেসব বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয় তাঁদেরও প্রয়োজন মতো অর্থদান করা যায়। গ্রামাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা হয় এবং তাঁদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করা যায়। বিহারযাত্রার পরিবর্তে এই ধর্মযাত্রাই হল অনুসংযানের প্রধান লক্ষ্য। রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে তিনি যে কেবল অনুসংযানে বেরোতেন তা নয়, তৃতীয় মুখ্য গিরিশাসনে তিনি যুক্ত, রজ্জুক ও প্রাদেশিকদের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একবার অনুসংযানে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিয়মিত অনুসংযান ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছিল। এই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করার জন্য তিনি রাস্তার ধারে বৃক্ষরোপণ, কূপখনন, বিশ্রামাগার স্থাপন করেছিলেন।
২) ধংমানুসষ্টি:-
অনু-শাস্ ধাতু থেকে সংস্কৃতে হয় অনুশিষ্টি। তারই প্রাকৃতরূপ অনুসষ্টি। ধংমানুসস্টি-র অর্থ ধর্মবিষয়ক উপদেশ দান। তৃতীয় মুখ্য গিরিশাসন থেকে বোঝা যায় যে, ধংমানুসষ্টির বিষয় ছিল -পিতামাতার শুশ্রূষা প্রভৃতি সর্বজনগ্রাহ্য কয়েকটি নীতির উপদেশ।
৩) যুতা চ রাজূকে চ প্রাদেশিকে চ:-
তৃতীয় মুখ্য গিরিশাসনে অশোক বলেছেন যে, তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র অনুসংযান ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। অশোক যে তিনজন অফিসারকে অনুসংযানে যাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা হলেন -যুক্ত, রজ্জুক ও প্রাদেশিক। যুক্ত প্রভৃতি কর্মচারী অনুসংযানে গিয়ে কি কি কাজ করবেন, সে সম্পর্কে তৃতীয় মুখ্য গিরিশাসন বলা হয়েছে- ‘এতায়েব অথায়, ইমায় ধংমানুসষ্টিয়, যথা অজ্ঞায়পি কংমায়। ‘ এখানে অথ=অর্থ বা উদ্দেশ্য। তাহলে ‘এতায়েব অর্থায় = এই উদ্দেশ্য। এখানে উদ্দেশ্য দুটি -ইমায় ধংমানুসষ্টিয়(এই ধর্মপ্রচার করা ) এবং অঞায়পি কংমায় (অন্যান্য সরকারি কাজ করা)।
৪) ভেরীঘোসো অহো ধংমঘোসো:-
অশোক বলেছেন, ভেরীঘোষ ধর্মঘোষে রূপান্তরিত হোল। ‘ভেরীঘোষ’ শব্দের অর্থ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। ভেরী মানে ঢাক। যুদ্ধে রনোন্মদনা জাগবার জন্য যেমন ঢাক বাজানো হয়, তেমনি ধর্মোৎসবের সময়ও ঢাক বাজানো হয়। কিন্তু অশোক যখন ভেরীঘোষকে ধর্মঘোষে রূপান্তরিত করলেন তখন প্রাণী হত্যা, জীব, হিংসা আত্মীয় স্বজনের প্রতি দুর্ব্যবহার, যা পূর্বতন রাজাদের আমলে বেড়ে গিয়েছিল, তা ধর্মঘোষের প্রভাবে আবার কমতে শুরু করল। তাই বড়ুয়া বলেছেন- “ভেরীঘোসা অহো ধর্মাঘোসা’- এই উক্তির একমাত্র উদ্দেশ্য প্রজাহিতৈষী পূর্ব পূর্ব রাজগণের অবলম্বিত ধর্মোৎসব এবং অশোকের অবলম্বিত ধর্মোপদেশ, প্রজাবর্গের ও জনমানবের আশানুরূপ চারিত্রোন্নতি সাধনের এই দুই উপায়ের কার্যকারিতার পার্থক্য দেখানো।
৫) অনারংভো প্রাণানং অবিহীসা ভূতানং:-
অশোকের ধর্মঘোষের ফলে যেসব ধর্মাচরণ সমাজে বৃদ্ধিলাভ করেছিল তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে চতুর্থ মুখ্য গিরিশাসনে। এই ধর্মাচরনগুলির মধ্যে অশোক প্রথমেই যেদুটির কথা বলেছেন সেদুটি হল – প্রাণীদের বধ না করা এবং জীবহিংসা না করা। এই দুটি ধর্মাচরনের সঙ্গে মৌর্য অর্থনীতির স্পষ্ট যোগ আছে। যানবাহনে বাঁচিয়ে রাখতো, অপরদিকে, তেমনি আমাদানি -রপ্তানীকে বাঁচিয়ে রেখে অর্থনীতিকে সজীব রাখতো। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, এই দুটি ধর্মাচরন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পরিপোষক।
৬) উষ্টানং চ অর্থসংতীরনা চ:-
অশোকের ষষ্ঠ মুখ্য গিরিশাসনে রাজকার্য পরিচালনার দুটি নীতির কথা বলা হয়েছে। একটি হল -উস্টান বা উত্থান, অপরটি হল- অর্থসংতীরনা। প্রথমটিতে আছে- কর্মোদ্যম আর দ্বিতীয়টিতে আছে তার প্রয়োগ। সেজন্যই অর্থসংতীরনাকে বাংলা অনুবাদে বলা হয়েছে রাজকর্ম সম্পাদন। অশোকের কাছে উত্থান কেবল রাজকর্ম পরিচালনার নীতিই নয়। এটা তাঁর জীবনের নীতিও বটে।
৭) পোরানা পকিতি:-
দ্বিতীয় ক্ষুদ্র গিরিশাসনে অশোক ধর্মকে আরও স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছেন। সর্বধর্মসারকে তিনি বলেছেন, পোরানা পকিতি অর্থাৎ চিরাগত প্রাচীন নীতি। তাই ভিনসেন্ট স্মিথ অশোকের সর্বধর্মসারকে ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ ‘The marality inculc ated (by Asoka) was, on the whole, common to all the indian religious ‘. অশোকের মতে, ধর্ম বা পোরানা পকিতি বলতে বোঝায় – পিতামাতা প্রমুখ গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, দাসভৃত্য প্রভৃতির প্রতি সদ্ব্যবহার, প্রাণীর প্রতি অহিংসা, দান, দয়া, অনালস্য, পরধর্ম, সহিষ্ণুতা সংযম, সত্যবচন, সংযম প্রভৃতি চরিত্র নীতি।
৮) ধর্মবিজয়ো:-
কলিঙ্গযুদ্ধের অশোকের জীবনে নতুন জীবনের বাণী বয়ে এনেছিল। যুদ্ধের নৃশংস হত্যালীলাকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে অশোক বিশ্বমৈত্রীর কঠোর সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। দিগ্বিজয়ের পরিবর্তে তিনি প্রচার করেছিলেন ধর্মবিজয়ের বাণী। কলিঙ্গযুদ্ধের পর অশোক যে ধর্মবিজয়ের প্রবর্তন করলেন তার মূলে ছিল মৈত্রী ও অহিংসা এবং লক্ষ্য ছিল বিশ্বমৈত্রী প্রতিষ্ঠা।
৯) লজূকা:-
দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা বলেছেন যে, তিনি লক্ষ লক্ষ জীবের উপর লজূক বা রজ্জুকের নিযুক্ত করেছেন। কিভাবে জনগনকে সুখী করা যায় এবং কিসে তারা দুঃখ পায়, রজ্জুকেরা তা জানবে এবং ধার্মিক লোকদের সাহায্যে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে এমনভাবে ধর্মোপদেশ দেবে যাতে তারা ইহলোক এবং পরলোকে সুখলাভ করে।
১০) ধংমনিয়মেন চ নিঝতয়া চ :-
দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা বলেছেন- মানুষদের এই যে ধর্মবৃদ্ধি, তা ঘটেছে দুভাবে -লোককে ধর্মসম্পর্কিত নিয়মাপালনে বাধ্য করে এবং লোককে ধর্মবিষয়ক চিন্তায় উৎসাহিত করে। এই দুয়ের মধ্যে ধর্মনিয়ম তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, ধর্মবিষয়ক ভাবনার দ্বারাই ধর্মচেতনার বৃদ্ধি হয়।
মূল্যায়ণ:-
আজ থেকে প্রায় সওয়া দুহাজার বছর আগে অশোক বুঝেছিলেন যে, যুদ্ধের দ্বারা রাজনৈতিক সমস্যার কোনও সমাধান হয় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে উঠেছিল ‘লীগ অব্ নেশনস্’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে উঠেছিল ‘ইউনাইটেড নেশনস্ অর্গানাইজেশন’। কিন্তু মানুষের যুদ্ধতৃষ্ণা এখনও মেটেনি। অশোকের বিশ্বমৈত্রীর স্বপ্ন সফল হবার সময় এখনও আসেনি। সেই প্রাচীন যুগের অশোক আমাদের আধুনিক যুগের রাষ্ট্রনায়কদের চেয়ে এখনও অনেক এগিয়ে রয়েছেন। আধুনিক যুগে ইতিহাসের আলোকে অশোক চর্চার প্রাসঙ্গিকতা এখানেই।
- অশোকের অনুশাসন: অশোককথিত ধর্মের স্বরূপ আলোচনা
- অশোকের অনুশাসন: দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা অশোকের ষষ্ঠমুখ্যগিরিশাসনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা