অশোকের অনুশাসন: দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্যগিরিশাসনের তাৎপর্য ব‍্যাখ‍্যা

অশোকের অনুশাসন অনুসারে দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্যগিরিশাসনের তাৎপর্য ব‍্যাখ‍্যা কর।

দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্যগিরিশাসনের তাৎপর্য ব‍্যাখ‍্যা কর – অশোকের অনুশাসন

ভূমিকা:- মগধের সিংহাসনে মহান অশোক অধিরূঢ় হয়েছিলেন  ঠিকই এবং তিনি যে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হয়েছিলেন তাও ঠিক। কিন্তু তুমি রাজোচিত বিলাস-ব্যসনে কালাতিপাত করেননি। তিনি ক্ষমতার দম্ভও করেননি। তিনি চেয়েছিলেন প্রজাবর্গের কল‍্যাণ করতে। তিনি ভেবেছিলেন রাজ‍্যশাসনের মাধ‍্যমে প্রজাদের  নিকট কৃত ঋন পরিশোধ করছেন।

রাজা অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্যগিরিশাসনের প্রাপ্তি স্থান

অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্যগিরিশাসনটি তাঁর রাজত্বের ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ বৎসরে বর্তমান গুজরাটের কাথিয়াবাড়ের অন্তর্গত গিরনার নামক স্থানে প্রাকৃত ভাষায় ও ব্রাহ্মী লিপিতে পাওয়া যায়। অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্য গিরিশাসনের তাৎপর্য এই যে, এখানে অশোকের রাষ্ট্রশাসননীতিটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

রাজা অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্যগিরিশাসনের বিভাগ

অশোকের গিরিশাসনটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

  • প্রথম অংশে তিনি বলেছেন পূর্ববর্তী রাজাদের আমল থেকে রাজসংক্রান্ত সংবাদ রাজার কাছে সরবরাহ করা হত না। তার জন্য অশোক যে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন সেগুলি আছে। 
  • দ্বিতীয় অংশে আছে তার রাজ্যশাসন প্রণালীর অন্তর্নিহিত ভাবনা।

দেবপ্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের তাৎপর্য গুলি নিম্নে আলোচিত হল-

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের প্রথম তাৎপর্য

  • প্রথমত, অশোকপূর্ব যুগে মগধ রাজাদের দিগ্বিজয়নীতির ফলে অঙ্গ, বৈশালী, কাশী, কেশল, অবন্তী প্রভৃতি রাজ‍্য একে একে মগধের অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং তারাই ফলে মগধ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হয়। বিজিত রাজ‍্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা না থাকলে মগধরাজাদের পক্ষে সাম্রাজ‍্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিলনা। তাই তখন থেকে সাম্রাজ‍্যবাদের পাশাপাশি রাজার সার্বভৌমত্বের ধারনাও প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের দ্বিতীয় তাৎপর্য

  • দ্বিতীয়ত, কলিঙ্গ যুদ্ধের হত‍্যালীলায় অশোকের মধ‍্যে যে ভাবান্তর ঘটে তা থেকেই তা থেকেই জন্মলাভ করে নতুন রাষ্ট্রশাসন নীতি।এই নতুন রাষ্ট্রনীতি নির্ধারনে অশোক পূর্বতন রাষ্ট্রনীতির সবকিছুকেই একেবারে বিসর্জন দেননি, তবে জনজীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে মানববাদী দৃষ্টিকোন থেকে পুনর্বিন‍্যস্ত করেছিলেন। এখানেই অশোকের রাষ্ট্রনীতির অভিনবত্ব।

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের তৃতীয় তাৎপর্য

  • তৃতীয়ত, অশোকের রাষ্ট্রনীতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রন আগের মতোই বজায় ছিল। ষষ্ঠমুখ‍্য গিরিশাসনে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। এখানে বলা আছে যে, সম্রাটের কোনো মৌখিক আদেশ বা মহামাত্রদের উপর অর্পিত জরুরী দায়িত্ব সম্পর্কে পরিষদে আলোচনার শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সে কথা তাকে অবিলম্বে জানাতে হলে-

” আনংতরং পটিবেদেতয়বং মে সর্বত সবে কালে।”

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের চতুর্থ তাৎপর্য

  • চতুর্থত, ২য় কলিঙ্গ লেখে অশোক বলেছেন, সকল মানুষই আমার সন্তান। যেমন- আমার সন্তানদের ক্ষেত্রে আমি ইহলোক ও পরলোকে তাদের মঙ্গল ও সুখ কামনা কবির  তেমনি সকল মানুষের ক্ষেত্রেও আমার একই কামনা। এই নৈতিক দায়িত্ব বোধকে তিনি কেবল নিজের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি, সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের মধ‍্যেও এই আদর্শ সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। তাই অশোক এই সামাজিক দায়বদ্ধতার জন‍্যই নিজেকে প্রজাদের সেবক বলে মনে করতেন। অশোক মনে করতেন, তিনি প্রজাদের কাছে ঋনে আবদ্ধ। সেই ঋন পরিশোধের জন‍্যই তিনি রাজ‍্যশাসন করছেন। তাই ষষ্ঠমুখ‍্য গিরিশাসনে বলেছেন,” ভূতানাং আনংনং গচ্ছেয়ম্।” জীবজগতের কাছে আমার ঋণ যেন পরিশোধিত হয়। এই ঋণ পরিশোধের জন্য তাঁর প্রাণান্তর পরিশ্রমের কথা এই গিরিশাসনে  স্পষ্ট বলা আছে।

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের পঞ্চম তাৎপর্য

  • পঞ্চমত, অশোক সবসময় এবং সব জায়গায় রাষ্ট্রের কাছে নিজেকে নিযুক্ত রাখতেন।  বলেছেন, এত পরিশ্রম করেও যেন তাঁর তৃপ্তি হয় না।

তাই তিনি বলেছেন যে, তাঁর  রাষ্ট্রশাসনের মূলমন্ত্র দুটি-উস্টান ও অর্থসংতীরনা-

“তস চ পুন এস মূলে উস্টানং চ অর্থ সংতীরনা চ।”

উস্টান বা উত্থান হল সদা জাগ্রত উদ্রম। উত্থান পরিপূর্ণতা লাভ করে তখনই, যখন আরব্ধ কর্মটি সুসমাপ্ত হয়। এই সুসমাপ্তিকেই তিনি বলেছেন অর্থসংতীরনা।

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের ষষ্ঠ তাৎপর্য

  • ষষ্ঠত, পিতৃকল্প রাজা ও প্রজাসেবক রাজার আদর্শ অশোকযুগের রাজতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রন করত। এই আদর্শভিত্তিক রাজ‍্যশাসনের মধ‍্য দিয়ে অশোক অলিখিতভাবে প্রজাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি মহামূল্যবান অধিকার -রাষ্ট্রের কাছে সুশাসনের অধিকার। অশোক মনে করতেন যে রাষ্ট্র বলতে একটি ভূখণ্ড মাত্রাকে বোঝায় না। রাষ্ট্রের রাজত্ব নির্ভর করে জনসমষ্টির উপর।

তাই অশোকের রাষ্ট্রশাসনের মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ-

” নাস্তি হি কংমতরং সর্বলোকিহিতপা।”

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের সপ্তম তাৎপর্য

  • সপ্তমত, ষষ্ঠ মুখ্য গিরিশাসনে অশোক বলেছেন যে,  পূর্বতন রাজাদের রাষ্ট্রশাসনে মানুষ উপেক্ষিত ছিল। মানুষের জীবনের কোথায় ঠিক ঘটছে, প্রতিবেদকেরা রাজাকে সেকথা যথাযথভাবে জানাত না। এটাই প্রমাণ করে পূর্বতন রাজাদের প্রজা সম্পর্কে অনাগ্রহ। তাঁদের কাছে প্রজা সুখের চেয়ে আত্মসুখ ছিল মূল্যবান।
  • তাই তাঁরা রাষ্ট্র প্রদক্ষিণের পরিবর্তে বিহার যাত্রায় যেতেন মৃগয়ার জন্য। রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির প্রতি এই অবহেলার ক্ষতিপূরণের জন্য অশোক একদিকে যেমন উত্থানকে অবলম্বন করে প্রজা কল‍্যাণে আত্মসমর্পণ করেছিলেন,  অপরদিকে তেমন রাষ্ট্র ও প্রজার  মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
  • এই জন্য তিনি উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের তিনি পাঁচ বৎসর অন্তর রাজ্য প্রদক্ষিণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর ফলে যাতায়াত ব্যবস্থা, অনুসংযান, জনকল্যাণ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি একসূত্রে বাঁধা পড়ে ছিল।

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের অষ্টম তাৎপর্য

  • অষ্টমত, অশোক যেভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন‍্য আবেদন করেছেন তা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, তাঁর সময় দেশের আবহাওয়া ধর্ম কলহে কলুষিত হয়ে উঠেছিল এবং ধর্মবিরোধীর ফলে রাষ্ট্রীয় সংহতি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। অশোক তাই ব্যক্তিগত ধর্মকে অন্তরালে রেখে এবং তৎকালে প্রচলিত বহু ধর্মের কোনটিরই দিকে না ঝুঁকে সব ধর্মের সারবস্তুরূপ কতকগুলি চারিত্র নীতিকে প্রজাদের সামনে তুলে ধরেছেন। একেই তিনি ধর্ম নামে চিহ্নিত করে সার্বজনীন ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ঐক্য স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের নবম তাৎপর্য

  • নবমত, অশোক দ্বিগবিজয় নীতির পরিবর্তে যে ধর্ম বিজয় নীতির প্রবর্তন করেছিলেন তার মূল ভিত্তি হল- মৈত্রী। তাঁর মতে, এই মৈত্রী সাধনাই মানুষে মানুষে ও রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারে । এই মৈত্রী সাধনার স্বার্থে অশোক বুদ্ধ প্রবর্তিত অহিংসা নীতিকে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

রাজা অশোকের ষষ্ঠ মুখ‍্য গিরিশাসনের দশম তাৎপর্য

  • দশমত, স্বদেশে রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে অশোক অহিংসা নীতি ও রাষ্ট্র শাসনের মধ্যে একটি সীমারেখা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি গ্রহণ করেছিলেন ধর্ম বিজয়ের নীতি। যার মূলকথা অহিংসা ও শত্রুতার পরিবর্তে মৈত্রীদান। তিনি নিজে দ্বিগবিজয় নীতি পরিহার করেই ক্ষান্ত হননি, বংশধরদেরও দ্বিগবিজয় পরিহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন- “ত এতায় অথায় অয়ং ধংমলিপি লেখপিতা কিংতি? চিরং তিষ্টেয় ইতি, তথা চ মে পুত্রা পোতা চ র্পপোর্তা চ অনুকতরং সব-লোক-হিতায়।”

রাজা অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্যগিরিশাসনের তাৎপর্য

          তাই অশোকের রাষ্ট্রনীতি বাস্তব সত‍্যকে উপেক্ষা করেনি, এটি কল্পলোকের আদর্শ নয়। সুতরাং অশোকের ষষ্ঠমুখ‍্য গিরিশাসন যে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ তা উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়।

Comments