পুরাণ সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও তাৎপর্য সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব তুলে ধরা হল।
পুরাণ সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও তাৎপর্য ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
ভূমিকাঃ-
ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সমাজ বেদভিত্তিক। কিন্তু বৈদিক ভাষা দুর্বোধ্য। ফলে বেদের মন্ত্র সমূহের যে তত্ত্ব ও তথ্য বীজাগারে নিহিত আছে সেগুলির মর্মার্থ সহজে হৃদয়ঙ্গম হয় না। তাই বেদের ভাষ্য পরিপূরকরূপে সর্বজনবোধ্য। এপিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারত তথা বহু পুরাণ ও উপপুরান।
পুরাণের সংখ্যা ও পুরাণ সমূহ
সাধারণভাবে পুরাণ বলতে বোঝায় প্রাচীন কথা। শাস্ত্রে বলা হয়েছে- “যস্মাৎ পুরা হি আসীৎ ইদং তৎ পুরাণম্।” অর্থাৎ যেখানে প্রাচীন কথা বর্ণিত হয়েছে তাই পুরান। পুরাকালের সৃষ্টি, ধর্ম,আচার-ব্যবহার প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা সংকলনকে সাধারণ ভাষায় পুরাণ বলা হয়।
পুরাণের সংখ্যা বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কোনোও মতভেদ নেই। সবসময় পুরাণের সংখ্যা ১৮ই বলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে শুধু পুরাণ বলতে আমরা ১৮টি মহাপুরাণকে বুঝব।
এই ১৮ টি মহাপুরাণ।যথা- ১)ব্রহ্মা২) পদ্ম ৩) বিষ্ণু ৪) শিব ৫) অগ্নি ৬) ভাগবত
৭) নারদীয় ৮) মার্কণ্ডেয় ৯) ভবিষ্য ১০) ব্রহ্মবৈবর্ত্ত ১১) লিঙ্গ ১২)বরাহ, ১৩) বামন, ১৪)কূর্ম, ১৫) মৎস্য, ১৬) গরুড়,১৭) স্কন্দ এবং ১৮) ব্রহ্মাণ্ড।
পুরাণের বিষয়বস্তু
পুরাণগুলির আলোচ্য বিষয়বস্তু হিসেবে পাঁচটি বা দশটি লক্ষণ এর কথা বলা হয়েছে। তবে পঞ্চলক্ষণেই বেশি প্রসিদ্ধ-
“সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মন্বন্তররাণি চ।
বংশানুচরিতঞ্চৈব পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্।।”
অর্থাৎ ,
সর্গঃ-
এর অর্থ হল সৃষ্টি।পৃথিবীর সৃষ্টি সংক্রান্ত পৌরাণিক ধারণার কথা বলা হয়েছে।
প্রতিসর্গঃ-
আগের সৃষ্টি প্রলয়ে ধ্বংস হবার পর সবকিছু আবার নতুন করে সৃষ্টি। এটাই প্রতিসর্গের আলোচ্য বিষয়।
বংশঃ-
দেববংশ,ঋষিবংশ ও ধর্মাধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা বংশের অন্তর্ভুক্ত।
মন্বন্তরঃ-
চতুর্দশ মনুর অধিকার কালের বর্ণনা।স্বায়ম্ভূব মনু থেকে আরম্ভ করে বৈবস্বত মনু হয়ে ভৌত মনে পর্যন্ত ১৪ টি মন্বন্তরের বর্ণনা।
বংশানুচরিতঃ-
বংশানুচরিত লক্ষণে বিভিন্ন ঐতিহাসিক রাজবংশের বর্ণনা পাওয়া যায়।
ভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুসারে পুরাণের দশটি লক্ষণ
ভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে আবার দশটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল –
সর্গঃ-
পঞ্চলক্ষণের সর্গের মতো এখানেও সৃষ্টির উৎপত্তি ক্রম বর্ণিত হয়েছে।
বিসর্গঃ-
এই লক্ষণে উপাধিযুক্ত জীবের সৃষ্টিকথা বর্ণিত হয়েছে।
বৃত্তিঃ-
প্রাণীদের জীবন নির্বাহের সামগ্রী।
রক্ষাঃ-
অবতারতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনা ও অবতারদের বর্ণনা।
অন্তরঃ-
পঞ্চলক্ষণে যেটি মন্বন্তর, দশলক্ষে সেটিই অন্তর।
বংশঃ-
উভয় প্রকার লক্ষণেই একই রকম।
বংশানুচরিতঃ-
দু’রকম লক্ষণের তালিকা বংশানুচরিতের বৈশিষ্ট্যও একই রকমের।
সংস্থাঃ-
পঞ্চলক্ষণ যা প্রতিসর্গ, দশলক্ষণে তাই সংস্থা।
হেতুঃ-
সংসার সৃষ্টির হেতু হিসেবে জীব কুলের বর্ণনা।
অপাশ্রয়ঃ-
সৃষ্টি ও প্রলয় যে তত্ত্বের দ্বারা বিশ্বচরাচরে প্রকাশিত হয়, তাকে অপাশ্রয় বলে।
পুরাণ সাহিত্যের তাৎপর্য -পুরাণের প্রভাব
ভারতীয় সাহিত্য সম্ভাবের মধ্যে নানা দিক দিয়ে পুরাণ সাহিত্যের মূল্য অপরিসীম। ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগের এবং ঐতিহাসিক যুগের প্রথম ভাগের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পুরাণ সাহিত্য থেকেই পাই।
১) রাজনৈতিকক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
পুরাণগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকে অযোধ্যার রাজা পরীক্ষিতের রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস জানতে হলে পুরাণ গুলিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। দেবতা, ঋষি ও মহান রাজাদের বংশ পরিচয় ও তাদের কর্ম সম্বন্ধে সঠিক বিবরণ সংরক্ষণ করে রাখায় ছিল পুরাণ সাহিত্যের উদ্দেশ্য।প্রাচীন রাজাদের মধ্যে শিশুনাগ, নন্দ, মৌর্য, শুঙ্গ ও গুপ্ত রাজবংশের বর্ণনা পুরাণগুলিতে পাওয়া যায়।
২) সামাজিকক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
যুগে যুগে আত্মপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ভারতীয় হিন্দু জাতি কিভাবে কাজ করেছে, জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবিলা করেছে এবং এসকল ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কিভাবে নতুন জাতীয় সত্ত্বার অভ্যুদয় ঘটেছে তার ইতিহাস জানার পক্ষেও পুরাণ সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
৩) ধর্মীয়ক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
পুরাণেই আমরা সর্বপ্রথম নানা মূর্তি, দেবমন্দির, তীর্থস্থান, ব্রত প্রভৃতির বর্ণনা পাই। এই যুগের সর্বসাধারণের মিলনস্থলরূপে দেবমন্দিরের সৃষ্টি। অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতার পরিবর্তে পুরাণে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, রাধা-কৃষ্ণ, শিব-দুর্গা প্রভৃতি নতুন দেবদেবীর সৃষ্টি হতে দেখা যায়। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর -এই ত্রিমৃতিবাদ এবং বৈষ্ণব,শৈব ও শক্তি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস পুরাণ সাহিত্যে নিবন্ধ।
৪) ভৌগোলিকক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
পুরাণ সাহিত্যে আমরা সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের একটি ভৌগোলিক ঐক্যবদ্ধ রূপ দেখতে পাই। এই সাহিত্যে সেযুগের অনেক ভৌগোলিক তথ্য নিবন্ধ আছে।
৫) সাহিত্যে পুরাণের প্রভাব-
সাহিত্যেও পুরাণের প্রভাব অসামান্য। রত্নাকারের ‘হরবিজয়’, মঙ্খের ‘শ্রীকন্ঠচরিত’, জয়দ্রথ বিরচিত ‘হরচরিত চিন্তামণি’। কাশ্মীরের কবি ক্ষেমেন্দ্রের ‘দশাবতারচরিত’ প্রভৃতি বিখ্যাত কাব্যগুলি বায়ু পুরাণ বা শিবপুরাণ এবং স্কন্দপুরাণের একাধিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত।
৬) প্রাদেশিকক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
ভারতবর্ষের মধ্যযুগীয় প্রাদেশিক কবিরাও পুরাণ থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি।বাংলা ভাষায় রচিত কবিকর্ণপুরের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। ভাগবত পুরাণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে কৃষ্ণদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’, কবিশেখরের ‘গোপালবিজয়’, বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ।
৭) শিক্ষায় পুরাণের প্রভাব
শতপথ ব্রাহ্মণ এবং ছান্দোগ্য উপনিষদে পুরাণকে পঞ্চমবেদ নামে অভিহিত করা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে পুরাণকে ধর্ম ও বিদ্যার অন্যতম আকর বলা হয়েছে।
৮) কর্মে পুরাণের প্রভাব
দেবালয় বা সাধারণের মিলনস্থানে পুরাণপাঠ পবিত্র কর্তব্য রূপে বিবেচিত হত। পুরাণ পাঠ, পুরাণহাতে নকল করাকে লোকে পুণ্যকর্ম বলে মনে করত।
৯) বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান ও সমানাধিকারে পুরাণের প্রভাব
শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে, বারব্রতে পরম শ্রদ্ধায় পুরাণ পঠিত হয়। বেদপাঠে ও বৈদিক ধর্মচর্চায় সকলের অধিকার না থাকলেও পুরাণ পাঠ এবং পৌরাণিক ধর্মানুষ্ঠানে স্ত্রীলোক এবং শুদ্রেরও সমান অধিকার ছিল।
১০) বেদের সরলীকরণে পুরাণের প্রভাব
পুরাণ কথকেরা প্রাচীন কাহিনীকে নতুন রূপদান করেছেন। নদী ও তীর্থস্থানের মহাত্ম্য, দানধর্ম, অতিথিসেবা প্রভৃতিও ধর্মাচরণের প্রকৃষ্ট পন্থা- একথা পুরানেই প্রথম উদঘোষিত হয়েছে।
১১) বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রভাবঃ-
অশ্বশাস্ত্র, গোশাস্ত্র,গজশাস্ত্র,অলংকারশাস্ত্র,ব্যাকরণ,ছন্দোবিজ্ঞান,যোগশাস্ত্র, নৃত্য ও সঙ্গীতশাস্ত্র প্রভৃতি প্রায় সব শাস্ত্রই বিভিন্ন পুরানে স্থান পেয়েছে।
১২) সৃষ্টিতত্ত্বে প্রভাবঃ-
এছাড়াও পুরাণ এর মধ্যে রয়েছে স্থাবর, জঙ্গম,দেবতা,অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ,মনুষ্য প্রভৃতির বৃত্তান্ত। রয়েছে সৃষ্টির বিবরন, ব্রহ্মার তত্ত্ব, অনন্তের তত্ত্ব,জীবতত্ত্ব, অবতারবাদ,পশু চিকিৎসার কথা, প্রতিমানির্মান ও রত্নবিচারের কথা ইত্যাদি।
১৩) বিচারক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
ভারতীয় আইন এবং বিচার পদ্ধতির ইতিহাস পর্যালোচনায় অগ্নিপুরাণের ব্যবহার অংশ অবশ্যই বিবেচনীয়।
১৪) বৈজ্ঞানিকক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
পুরাণগুলিতে বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু আলোচনা আছে।যেমন- আয়ুর্বেদ, গণিত ইত্যাদি।
১৫) পর্যটনেক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
মৎস পুরানে দেখা যায় যে, বায়ুদেব যুধিষ্ঠিরকে তীর্থপর্যটনের উপদেশ দিচ্ছেন। কারণ, বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠান দরিদ্রের জন্য নয়, তাতে এত উপকরণ লাগে যে কেবল রাজা বা ধনী লোকেরাই সংগ্রহ করতে সক্ষম। মৎস পুরানের সাড়ে তিন কোটি তীর্থস্থান এর কথা উক্ত হয়েছে।
১৬) শিল্পক্ষেত্রে পুরাণের প্রভাব
ধর্মনিরপেক্ষ শিল্পের প্রসারে ও বিকাশে পুরাণ গুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৭) মূল্যবোধে পুরাণের প্রভাব
পৌরাণিক আদর্শ হল সত্য ও অহিংসা। সত্য কেবলমাত্র অধ্যাত্মচেতনা নয়। কায়িক,কঠিন মানসিক। বস্তুতঃ সমস্ত কিছুর বিশুদ্ধিকরন, ও অধ্যাত্মভাবনার ভিত্তি হল সর্বভূতে দয়া, মমতাভাব, দানধর্মের ও অহিংসার কল্যানবুদ্ধি – যা পুরাণ সমূহে উপস্থিত হয়েছে।
পুরাণ সাহিত্যের সার্বিক বিচার
সুতরাং, সমস্ত পুরাণ সাহিত্যের সার্বিক বিচার – বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো যে এগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষের প্রাগৈতিহাসিক যুগের এবং পুরাণ সমকালীন ঐতিহাসিক যুগের নানাবিধ মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সন্নিবেশ।
তথ্য সুত্র –
একনজরে পুরাণ সম্পর্কে আলোচনা (modernsanskrit.in)
পুরাণ সম্পর্কে বিভিন্ন পোস্ট গুলি
পুরাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য বিস্তারিত জানুন