মেঘদূতে বর্ণিত যক্ষবধূর বর্ণনা দাও এবং কবি কালিদাসের কৃতিত্ব লেখ।
মেঘদূতে বর্ণিত যক্ষবধূর বর্ণনা দাও ও কবি কালিদাসের কৃতিত্ব
উ:- ভূমিকা:- বাণীর বরপুত্র কালিদাসের লেখা মেঘদূতম্ নামক গীতিকাব্যের উত্তরমেঘ-এ রয়েছে যক্ষবধূর বর্ণনা। মেঘদূতম্ কাব্যে বর্ণিত অলকানগরীর বর্ণনার শেষে কবি যক্ষিণীর রূপ এঁকেছেন স্রষ্টার প্রথম সৃষ্টি হিসাবে। এই রূপ যক্ষের কাছে চেনা-অচেনার সমন্বয়ে গাঁথা।
মেঘদূতে বর্ণিত যক্ষবধূর বর্ণনা
যক্ষ মেঘের কাছে নিজের প্রিয়ার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন-
” তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্টী
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ।
শ্রোণীভারাদলসগমনা স্তোকনম্রাস্তনাভ্যাং
যা তত্র স্যাৎ যুবতিবিষয়ে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতুঃ।।”
অর্থাৎ যক্ষপত্নী তণ্বী, তপ্তকাঞ্চনাভা, তার দন্তপংক্তি ডালিম বীজের মতো, অধর-ওষ্ঠ বিম্বফলের মতো রক্তাভ; কঠিদেশ ক্ষীণ, চকিত হরিণীর মতো তাঁর চোখ, নাভি গভীর, নিতম্বের গুরুভারে সে শ্লথগতি এবং স্তনভারে ঈষৎ আনত। তাকে দেখে যুবতীদের মধ্যে। তাকে বিধাতার প্রথম সৃষ্টি বলে মনে হবে কালিদাস এই শ্লোকে যক্ষপত্নীর রূপ বর্ণনা যেভাবে দিলেন তাতে তার বিবিধ শাস্ত্রে গভীর পান্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। যক্ষপত্নী যে পদ্মিনী নারী তার ব্যঞ্জনা আছে এই শ্লোকে।
যক্ষকে হারিয়ে আজ যক্ষপত্নী চক্রবাকীর মতো একাকিনী বিরহব্রত উদযাপন করছে। শিশিরমথিতা পদ্মিণীর মতো তার অবস্থাও করুন। যক্ষপত্নী সুদীর্ঘ আটমাস বিরহযন্ত্রনা সহ্য করে চলেছে। এতদিনে সে বিধাতার দেওয়া অপরিমিত সৌন্দর্যরাশির অধীশ্বরী হয়েও বিরহ বিষাদে মলিন রূপ ধারণ করেছে। সে এখন হিমহতা নলিনীর প্রতিরূপ বলা চলে। অবিরল কান্নায় তার চোখদুটি ফুলে উঠেছে, নিশ্বাসের উষ্ণতাঋ অধরোষ্ট বিবর্ণ হয়ে গেছে, খোলা চুল এসে পড়ায় তার মুখ পুরোপরি দেখা গেছে, খোলা চুল এসে পড়ায় তার মুখ পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। মেঘে ঢাকা পড়া চাঁদ যেন। যক্ষপ্রিয়ার বিরহে দিনগুলো কাটছে হয়তো স্বামীর
মঙ্গলকামনায় অভীষ্ট দেবতার পূজা কর্ম করে। যক্ষ যে এতদিনে অনেক কৃশ হয়ে গেছে, তা অনুমান করে যক্ষের বর্তমান ছবি আঁকছে যক্ষপ্রিয়া। আবার এমনও হতে পারে, সে তাঁর পোষা ময়নাকে প্রশ্ন করছে- যক্ষকে তাঁর মনে পড়ছে কিনা। বিরহের চিত্র হিসেবে ভারতীয় সাহিত্যে এসব ছবি অতি পরিচিত।
সঙ্গীত নিপুনা হয়েও যক্ষপত্নী এমন সংগীতহারা। কোলে সেতার তুলে নিয়েছে, কিন্তু তাতে সুর উঠছেনা। আজ তার চোখের জলে সেই বীণার তার ভিজে যাচ্ছে, সে তা মুছে দিয়ে বারবার চেষ্টা করেও নিজেরই দেওয়া সুর কিছুতেই মনে করতে পারছে না। কবির ভাষায়-
“উৎসঙ্গে বা মলিনবসনে সৌম্য নিক্ষিপ্য বীণাং
মদগোত্রাঙ্কং বিরচিতপদং গেয়মুদগোতুকামা।
তন্ত্রীমোর্দ্রাং নয়নসলিলেঃ সারয়িত্বা কথঞ্চিৎ,
ভূয়োভূয়ঃ স্বয়মপি কৃতাং মূর্ছণাং বিস্মরন্তী।।”
হয়তো বা দেখবে- বিরহের অবশিষ্ট দিন গোনার জন্য সে দেউড়িতে দেওয়া ফুলগুলি মাটিতে বিছিয়ে গুনছে। কিংবা মনে মনে যক্ষকে কাছে পাওয়ার আনন্দ আস্বাদ করছে। নিদ্রাহীন রাত সে মাটিতে শুয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় মেঘ অবশ্যই তার বন্ধুপত্নীকে যক্ষের কুশল সংবাদ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করবে। মনের দুঃখে যক্ষপ্রিয়ার দেহ ক্ষীণ হয়ে গেছে, বিরহশয্যার একপাশে শুয়ে আছে। তাকে দেখে মেঘের মনে হবে যেন পূর্ব দিগন্তে কলামাত্র অবশিষ্ট চাঁদের শীর্ণরেখা। মিলনের রাত ছোট কিন্তু বিরহের রাত দীর্ঘ। তাই বিরহের দীর্ঘরাত উষ্ণ অশ্রু বিসর্জন করে সে অতিবাহিত করছে। চাঁদের কিরণ তাকে আর আনন্দ দেয় না। বিরহের দুঃখে সে যেন জলভরা চোখের পালক দিয়ে চোখ ঢাকতে চায়। ওই চোখ দেখে মেঘের মনে হবে তা যেন মেঘে ঢাকা দিয়ে না-ফোটা- না বোঝা পদ্ম। কবির ভাষায়-
” পাদানিন্দোরমৃতশিশিরাঞ্ জালমার্গ প্রবিষ্ঠান্।
পূর্বপ্রীত্যা গতমভিমুখং সন্নিবৃত্তং তথৈব।
চক্ষুঃ খোদাৎ সলিলগুরুভিঃ পদ্মভিশ্ছাদয়ন্তীং
সাভ্রেহহ্নীব সুলকমলিনীং ন প্রবৃদ্ধাং ন সুপ্তাম্।।”
কামদশায় অন্যতম হল বিষয়বিদ্বেষ। মিলনের সময় যা যা প্রীতিকর মনে হত, সেই সবই এখন যক্ষবধূর অরতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেশসংস্কারের অভাবে তার চুলগুলি রুক্ষ, উষ্ণ নিঃশ্বাসবায়ু তার অধরকে পীড়া দেয়, চুলগুলিকে এলোমেলো করে দেয়। যদি স্বপ্নেও যক্ষের সাথে সঙ্গলাভ ঘটে এই আশায় যক্ষপ্রিয়া ঘুমাতে চায়, কিন্তু দুচোখ জলে ভরে থাকে বলে ঘুম আর আসে না। সে অপেক্ষা করে আছে, কবে বিরহের অবসানে তার প্রিয়তম ফিরে এসে শেষ বাঁধা চুল খুলে দেবে। সেই অবলা সব খুলে ফেলে তার কোমল দেহটি বারংবার নিদারুণ দুঃখে শয্যার কোলে ধারন করে রাখছে। যক্ষপত্নীর এজাতীয় করুণ দশা দেখে মেঘও নিজেকে স্থির রাখতে পারবে না। কারণ, সব আর্দ্রহৃদয় ব্যক্তিরাই করুনপরবশ হয়ে থাকেন। কাজল ছাড়া চোখে, মদিরা ছাড়া দৃষ্টিতে যক্ষপত্নী যখন মেঘকে দেখবে তখন তার চোখের পাতায় স্পন্দন জাগবে, বাম ঊরু কেঁপে উঠবে, তাতেই শুভ সংকেত সূচিত হবে। কবির ভাষায়-
” বামশ্চাস্যাঃ কররুঅপদৈর্মুচ্যমানো মদীয়ে-
মুক্তাজালং চিরপরিচিতিং ত্যাজিতো দৈবগত্যা।
সম্ভোগান্তে মম সমুচিতো হস্তসংবাহনানাং
যাস্যত্যূরুঃ সরসকদলীস্তম্ভ গৌরশ্চলত্বম্।।”
যক্ষবধূ আয়াসলব্ধ স্বপ্ন নিদ্রায় স্বপ্নে সম্ভোগসুখ অনুভব করতে পারে। সুতরাং সেই সময় মেঘ যেন গর্জন করে তার নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নিদ্রাভঙ্গ পর্যন্ত অপেক্ষা করে।
মেঘদূতে বর্ণিত যক্ষবধূর বর্ণনা অনুসারে কবি কালিদাসের কৃতিত্ব / মূল্যায়ণ:-
যক্ষিণীর আবেগমথিত চিত্রটির করুণরস শব্দচিত্রে যেন হালকা রঙের প্রলেপ দিয়েছে। অলকাবর্ণনায় কবি যে গাঢ়রঙের ব্যবহার করেছেন তার পাশে এই ভাবচিত্রের বর্ণচেতনা অবশ্যই পৃথক। প্রকৃতপক্ষে চিত্রের ক্ষেত্রে গাঢ়রঙের ক্যানভাসে হালকা রঙের দুঃখ চিত্র যেভাবে কারণ্যের রূপ পায়, এখানেও মহাকবি কালিদাস চিত্র রচনার ক্ষেত্রে সেই টেকনিক নিয়েছেন।
কবি যক্ষপ্রিয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে আমরা বিরহ কাতর ও পতিগতপ্রাণা পত্নীকে প্রত্যক্ষ করি। একদিকে তার অসাধারণ শরীরী সৌন্দর্য, অন্যদিকে তার বিরহব্যথা দুইই আমাদের মুগ্ধ করে। প্রচন্ড দুঃখেও স্বামীর প্রতি তার গভীর ভালোবাসা কালিদাসের লেখনীতে অসাধারন হয়ে উঠেছে।এর থেকে মনে হয় কালিদাসই যেন যক্ষ হয়ে বিরহিনী বধূর ছবি এঁকেছেন।