কাদম্বরী অনুসারে চন্দ্রাপীড়ের প্রতি শুকনাসের উপাদেশাবলীর সারাংশ নিজের ভাষায় লেখ।
কাদম্বরী অনুসারে চন্দ্রাপীড়ের প্রতি শুকনাসের উপাদেশাবলীর সারাংশ নিজের ভাষায় লেখ
উ:- বাক্ পতিরাজ বানভট্ট কবিদের কবি, লেখকদের লেখক কেমন করে দেখতে হয়, অনুভব করতে হয়, লিখতে হয় তার লেখার প্রতি ছত্রেই শিক্ষানবীশ লেখকতার পরিচয় পাই। সেই অসম্ভব প্রতিভাধর বানের চিত্রভূমি এক আশ্চর্য রঙিন কল্পলোক। কাদম্বরী সেই কল্পলোকের এক বর্নাট্য কথাচিত্র। সেই কথা কাব্যে অত্যন্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে শুকনাসের উপদেশাবলী।
উজ্জয়িনীর রাজা তারাপীড়ের প্রধান অমাত্য শুকনাস। তারাপীড়ের পুত্র চন্দ্রাপীড় যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার পূর্বে মন্ত্রী শুকনাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে শুকনাস বিনয়ী চন্দ্রাপীড়কে অধিক বিনয়ী করার ইচ্ছায় উপদেশ প্রদান করে বললেন, –
“যৌবনারম্ভে চ প্রায়ঃ শাস্ত্রজলপ্রক্ষালননির্মলাপি কালুষ্যমুপযাতি বুদ্ধিঃ’।
অর্থাৎ যৌবনকাল উপস্থিত হলে মানুষের মন স্বভাবতই মোহে আচ্ছন্ন থাকে। যদিও চন্দ্রাপীড় সর্বশাস্ত্রে অভিজ্ঞ, ধীর স্বভাতযুক্ত তবুও সময়ে সতর্কতা প্রয়োজন তবুও সময়ে সতর্কতা প্রয়োজন। যেহেতু গর্ব ও বিষয় আকর্ষন বড় ভয়ঙ্কর।
নবযৌবনের করালরূপ মানব মনে এখন গাঢ় অন্ধকার সৃষ্টি করে যে অন্ধকার সূর্যালোক অথবা মনির প্রভাবে বিনষ্ট হয় না-
” অতিগহনং তমঃ যৌবনপ্রভবম্।”
বনের সাথে যদি বিশাল ধনসম্পত্তি সংযোগ হয় তাহলে ঐ ঐশ্বর্য্যের মোহে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। কোনো অবস্থাতেই তার উপসম হয় না।
” অপরিণাম উপশমঃ দারুনঃ লক্ষ্মীমদঃ।”
নবযৌবনকালে অপরূপ সৌন্দর্য, অমানুষিক শক্তি ও প্রভুত্ব প্রত্যেকটি অনিষ্টকর। যদি এদের একত্রে সংযোগ ঘটে তাহলে তো কথাই নেই, চরম অনর্থ অবশ্যই ঘটবে-
” মহতী ইয়ং খলু অনর্থপরং পরা”।
শাস্ত্র জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বুদ্ধি কলুষিত হয়। একবার বিষয় রসের আস্বাদ পেলে সেই হৃদয়ে আর কোনো উপদেশই প্রবেশ করে না। যেহেতু চন্দ্রাপীড়ের বিষয় নেশা এখনও জন্মেনি তার পক্ষে এটি উপদেশ লাভের উপযুক্ত সময়। জল যেমন বাড়বা নলকে রোধ করতে পারে না তেমনি পুঁথিগত বিদ্যা, সৎ বংশ দুঃপ্রবৃত্তিকে বোধ করতে পারে না-
” প্রশমহেতুনা অপি ন প্রচন্ডতরী ভবতি বড়বানলঃ বারিণা?”
যৌবনের প্রবল আকর্ষন ইচ্ছামত মানুষকে দূরে সরিয়ে নেয়, মরিচীকার মতো ইন্দ্র সমূহকে টেনে নিয়ে যায়। যৌবন আগমে কাম ক্রোধাদি যুক্ত চিত্তে ভোগ্য বস্তু সমূহ মধুর না।হলেও মধুর বলে মনে হয়-
” নাশয়তি চ দিভ্ মোহঃ ইব সন্মার্গপ্রবর্ত্তকঃ পুরুষং অত্যাসঙ্গংবিষয়েষু।”
একসময় গুরুর উপদেশ অসৎ ব্যাক্তির কর্ণে পীড়া সৃষ্টি করে, অপরদিকে সৎ ব্যাক্তি গুরুর উপদেশকে হস্তির কর্ণ ভূষণের মতো সাদরে গ্রহণ করে-
” করিণ ইব শঙ্খাভরণম্ আননশোভাসমুদয়ম্ অধিকতরম্ উপজনয়তি।”
একমাত্র সৎ গুরুর উপদেশই মানুষের জরাহীন বার্ধক্য। জলহীন স্নান, উদ্বেগহীন স্বার্থকতা লাভ করতে পারে। রাজাদের পক্ষে এরূপ উপদেশের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু উপদেশ দিতে কেউ সাহস করে না বরং অনুগ্রহ লাভের আশায় থাকলে তার চাটুকারিতা করে থাকে-
” বিরলা হি তেষাম্ উপদেষ্টারঃ।
প্রতিশব্দক ইব রাজবচনম্ অনুগচ্ছতি জনঃ ভয়াৎ।।”
যৌবন কালের এই ভয়াবহতা আলোচনার পর বিচক্ষণ মন্ত্রী শুকনাস রাজলক্ষ্মী অর্থাৎ রাজার প্রভুত্ব ধন ঐশ্বর্যের কষ্টদায়ক একটি মনোজ্ঞ রূপ তুলে ধরেছেন। অত্যন্ত চঞ্চলা স্বভাব লক্ষ্মীকে অনেক সাবধানে লাভ করতে হয়। আর পালন করতে হয় নান রকম ক্লেশে। কারণ এই লক্ষ্মী কূল, শীল, রূপ বিদ্যা, ত্যাগ, আচার শত শুভলক্ষণ কোন কিছুর তোয়াক্কা করেন না-
” ন পরিচয়ং রক্ষতি, ন অভিজনং ইক্ষতে, ন রূপম্ আলোকয়তে, ন কুলক্রমম অনুবর্ততে, ন শীলং পশ্যতি….ন লক্ষণং প্রমাণীকরোতি। “
এই লক্ষ্মী সাধারন মানুষকে উন্মত্ত করে তোলেন। এবং বিদ্বান, বুদ্ধিমান, গুনবান্, উদারচেতা ব্যাক্তির বুদ্ধি ভংশ হয় এই দুরাচারিণী লক্ষ্মীর কৃপালাভে। এই লক্ষ্মীর দ্বারা সকলে অবিনয়ের পাত্র হয়ে ওঠেন। কেউ সম্পদের মোহে বিহ্বল হয়ে যান। কেউ ঐশ্বর্যের উষ্মায় ফেটে পড়েন। কেউ বা অঙ্গের ভার যেন বহন করতে পারেন না, কথা বলতেও ক্লেশ অনুভব করেন। এমন লোক নিতান্তই বিরল যিনি ণিচ স্বভাবা লক্ষ্মীর দ্বারা পূর্বে আলিঙ্গিত হয়ে পরে প্রতারিত হননি। এই প্রসঙ্গে শুকনাস বলেছেন-
” তরঙ্গ বুদ্ বুদ চঞ্চলা ….. পাতালগুহা ইব তমঃ বহুলা। … দুষ্ট পিশাচী ইব দর্শিত অনেক পুরষোচ্ছ্রায়া স্বল্পসত্ত্বম্ উন্মত্তীকরোতি। “
এই লক্ষ্মীর দ্বারাই রাজন্য বর্গের অনেক বিড়ম্বনা ঘটে থাকে। যে সকল ধূর্ত মানুষ বঞ্চনায় চতুর স্বার্থ সাধনায় তৎপর তারা রাজন্যবর্গের দোষ গুলিকেও গুন বলে প্রতিপন্ন করে থাকে-
” দোষান্ অপি গুনপক্ষ মধ্যারোপয়দ্ভিঃ।”
তারা মনে করে পাশা খেলা যেন আমোদ, মদ্যপান যেন বিলাস, প্রমও যেন বিরত্ব, স্বেচ্ছাচারিতা যেন প্রভূত্ব, চঞ্চলতা যেন উৎসাহ-
“অলীক অভিমানোন্মাদকারীনি ধনানি। রাজ্যাবিষবিকার তন্দ্রীপ্রদা রাজলক্ষ্মীঃ।”
চাটুকাররা রাজাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এমন স্তুতিবাদ করতে থাকে যে তা শুনতে শুনতে ওই সব রাজন্যবর্গ নিজেদের দেবতা রূপে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে যান। মনে করেন যেন তাঁদের মাঝে অন্য দুখানি হাত লুকানা আছে। যেন তাদের ললাটেও তৃতীয় নয়ন। এরূপ অসত্য মাহাত্ম্যের গর্বে স্ফীত হয়ে তারা মনে করে কারোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা মানে তাকে পবিত্র করা। ব্রাহ্মণ ও দেবতা অর্থাৎ যারা প্রণম্য তাদের প্রতি সম্মান না করাই যেন তাদের প্রথা।
সুতরাং এইরূপ জটিলরাজ্য শাসন প্রনালীতে যৌবনদশা প্রাপ্ত চন্দ্রাপীড়ের পক্ষে সংযত হয়ে চলাই উচিত। যেন রাজকুমার মোহময় যৌবনে নিজের আচরনের দ্বারা লোকের উপহাসের পাত্র না হন। সাধুদের দ্বারা নিন্দিত না হন, গুরুজনদের দ্বারা ধিক্কৃত না হন। বন্ধু দ্বারা তিরস্কৃত না হন, পণ্ডিতগণের অনুশোচনার বিষয় না হন-
” অস্মিন্ মহামোহানুকারিণি চ যৌবনে কুমার! তথা প্রযতেথা যথা ন উপহস্যসে জনৈঃ, ন নিন্দ্যসে সাধুভিঃ, ন ধিক্ ক্রিয়সে গুরুভিঃ, ন উপালভ্যসে সুহৃদভিঃ, ন শোচ্যসে বিদ্বদ্ভিঃ।”
সুতরাং যুবরাজপদে আরোহন পূর্বক শক্রগনকে অবগত ও বন্ধুগনকে উন্নত করার উপদেশ দিয়ে উপসংহারে শুকনাস দ্বিগ্বিজয় যাত্রার জন্য অনুরোধ করলেন। কারণ –
” অয়ং চ তে কালঃ প্রতাপম্ আরোপয়িতুম্।”
যৌবনই পরাক্রম প্রকাশের উপযুক্তকাল। যে নৃপতি পরাক্রান্ত হন তিনি সকলের দ্বারামান্য হয়ে থাকেন।
আরো পড়ুন – কাদম্বরী সম্পর্কে পোস্টগুলি
- কাদম্বরী: শুকনাসোপদেশঃ( সংস্কৃত ব্যাখ্যা)
- কাদম্বরী: সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- ‘কাদম্বরী’ কথা না আখ্যায়িকা
- কাদম্বরী: চন্দ্রাপীড়ের প্রতি শুকনাসের উপাদেশাবলী
- বানভট্টকে অনুসরন করে মহাশ্বেতার রূপ বর্ণনা কর
- বাণভট্ট রচিত কাদম্বরী কথা না আখ্যায়িকা আলোচনা কর
- বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ – ব্যাখ্যা কর
- বাণোছিষ্টং জগৎ সর্বম্- কাদম্বরী পাঠ্যাংশের অনুসারে বর্ননা