কাদম্বরী কথা না আখ্যায়িকা আলোচনা কর।কাদম্বরী (বাণভট্ট ) কথা না আখ্যায়িকা আলোচনা কর।
কাদম্বরী কথা না আখ্যায়িকা
উঃ- অলংকার শাস্ত্রের মতে সমগ্র কাব্য জগত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত দৃশ্য-শ্রব্য। শ্রব্যকাব্য আবার গদ্য,পদ্য ও মিশ্রভেদে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত।
অলংকার শাস্ত্র মতে গদ্যের লক্ষণ হলো- অপাদঃ পদসন্তানো গদ্যম্। অর্থাৎ পদ্যের মতো ছন্দের বন্ধন ও চরণ বিভাগ থাকবেনা গদ্যে। কিন্তু রস ধ্বনি গুন অলংকার সংযোজন গদ্য রচনায় একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। যার ফলে গদ্য হয়ে উঠে সহৃদয় হৃদয় সংবাদী এক অনাবিল লোকাত্তর অনুভূতি- বেদসাহিত্য বা কাব্য।
বিশ্বনাথ বলেছেন-
বাক্যং রসাত্মকং কাব্যং”।
সেই কারণেই অখন্ড স্বপ্রকাশ ব্রহ্মস্বাদসহোদর এবং লোকাত্তর চমৎকারিত্বের জনক রূপে রসের উপস্থাপনা করে বলেই গদ্য রচনা কেও কাব্য রূপে স্বীকৃতি দিয়েছেন আলংকারিকেরা।
তারা গদ্যকেই কবি প্রতিভা বিচারের কষ্টিপাথর বলেছেন-
গদ্যং কবীনাং নিকষং বদন্তি।
লোককথার বর্ণনাত্মক উপাদান নিয়ে গদ্যকাব্যের আবির্ভাব প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত নানা ঘটনার আপনাকে রাঙিয়ে এবং মহাকাব্যের অনুকরণে একটি বিশিষ্ট শৈল্পিক সুচারু রচনারীতি সৃষ্টি করে গুন ও অলংকারের জৌলুসে বর্ণন শিল্পের মায়াজাল সৃষ্টি করে বিশিষ্ট মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংস্কৃত গদ্য। জনপ্রিয় লোককথা বা কাহিনী কাব্য সৌন্দর্যে অলংকৃত হয়ে গদ্যকাব্যের রাজদরবারে আসন লাভ করেছে।
প্রাচীন আলংকারিক ভামহ সর্বপ্রথম কথা ও আখ্যায়িকার পার্থক্য আলোচনা করেন। পরবর্তী সংস্কৃত আলংকারিক এরা সকলেই নিজ নিজ গ্রন্থে কথা ও আখ্যায়িকার লক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
আখ্যায়িকা কাব্যের সম্বন্ধে বলেছেন-
- ১) প্রকৃতানুকুলশ্রব্যশব্দার্থ পদবৃত্তিনা- অর্থাৎ বিষয়বস্তু হবে লোকানুবর্তী। শ্রব্য শব্দার্থ পদবৃত্তি থাকবে আখ্যায়িকাতে। তাই গদ্যটি বলতে হবে মনোরম গদ্য।
- ২) গদ্যের বক্তব্য পৃথক পৃথক পরিচ্ছেদে বিভক্ত থাকবে এবং পরিচ্ছেদ গুলি- সোচ্ছাসাখ্যায়িকামতা। অতএব পরিচ্ছেদ গুলিকে পরিচ্ছেদ না বলে সেগুলিকে উচ্ছ্বাস নামে বলতে হবে।
- ৩) বৃত্তমাখ্যায়তে তস্যাং নায়কেন স্বচেষ্টিতম্’ – নায়ক নিজে আখ্যানভাগ এর বক্তা হবেন।
- ৪) বক্ত্রং চাপরবক্ত্রব্যকালে ভাব্যর্থশংসি চ- এই নিয়ম অনুযায়ী বক্ত্র, অপর বক্ত্রে ছন্দের ভাবী ঘটনা সূচক কবিতা থাকবে।৫) কবেরভিপ্রায়কৃতৈঃ কথনৈঃ কৈশ্চিদঙ্কিতা- কবির কল্পনার অবকাশ থাকবে।
- ৬) ফলত কবি কল্পনায় ঐ আখ্যায়িকা গদ্যকাব্যের মধ্যে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হবে সেগুলি হল- কন্যাহরনসংগ্রামবিপ্রলম্ভোদয়ান্বিতা’। অর্থাৎ কন্যা হরণ যুদ্ধ বিরহ এবং নায়কের উদয় বা অভ্যুদয় ইত্যাদি বিষয়বস্তু আখ্যায়িকা কাব্যে থাকবে। রচনার ভাষা হবে সংস্কৃত। তাতে অপভ্রংশ ইত্যাদি ভাষা থাকবে না।
কথাপ্রসঙ্গে ভামহের অভিমত হলো-
- ১) ন বক্ত্রাপরবক্ত্রাভ্যাং যুদ্ধা নোচ্ছ্বাসবত্যপি- অর্থাৎ কথা কাব্যে বক্ত্র বা অপরবক্ত্রের ছন্দের শ্লোক থাকবে না, উচ্ছ্বাস ভাগ থাকবে না।
- ২) কথা কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- সংস্কৃতং সংস্কৃতা চেষ্টা কথাপভ্র্যংশভাকতথা’- অর্থাৎ কেবল সংস্কৃতে নয় অপভ্রংশে তা রচিত হবে।
- ৩) অন্যৈঃ স্বরচিতং তস্যাং নারকেন তু নোচ্যতে- অর্থাৎ নায়ক গল্পের বক্তা হতে পারবেন না অন্য কাউকে গল্পের বক্তা হতে হবে।
বিশ্বনাথ কবিরাজ সাহিত্য দর্পণে কথা ও আখ্যায়িকার কতিপয় বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে কথা কাব্যের বৈশিষ্ট্য হলো- কথায়াং সরসংবস্তু গদ্যৈরেব বিনির্মিতম্।’ শৃঙ্গাররসাত্মক সরস গদ্যময় কাব্য কথাকাব্য নামে পরিচিত।এই কাব্যের কোথাও আর্যা, কোথাও বক্ত্র,কোথাও অপরবক্ত্র ছন্দময় বাক্য থাকবে এবং আদৌ পদ্যৈর্নমস্কারঃ খলাদের্বৃত্তকীর্ত্তনম্’- আদিতে পদ্যের দ্বারা ইষ্ট দেবতার নমস্কার, স্বজন দুর্জনের চরিত্র বর্ণনা, খলনিন্দা ও সাধু প্রশংসা থাকবে।
বিশ্বনাথ আখ্যায়িকার স্বরূপ প্রসঙ্গে বলেছেন
অনুরূপভাবে বিশ্বনাথ আখ্যায়িকার স্বরূপ প্রসঙ্গে বলেছেন-
আখ্যায়িকা কথাবৎ স্যাৎ কর্ব্বেংশানুকীর্তনম্।
আখ্যায়িকায় কথা কাব্যের মত কবির বংশ বর্ণনা থাকবে। অন্য কবিদের বৃত্তান্তও রচিত শ্লোকে মাঝে মাঝে থাকবে-
তস্যামন্যকবীনাঞ্চবৃত্তং পদ্যং ক্বচিৎ ক্বচিৎ ‘-
আখ্যায়িকার পরিচ্ছেদসমূহ আশ্বাস নামে পরিচিত হবে। আর্যা,বক্ত্র, অপরবক্ত্র যে কোন ছন্দে অন্য বিষয়ে বর্ণনা প্রসঙ্গে ভাবি বৃত্তান্তের সূচনা থাকবে তাই তিনি বললেন- অন্যাপদেশেনাশ্বাসমুখে ভাব্যর্থসূচনম্।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে কাব্যাদর্শ গ্রন্থে আচার্য দণ্ডি কথা ও আখ্যায়িকার মৌলিক প্রভেদ স্বীকার করেন না।
তার মতে কথা ও আখ্যায়িকা হলো একই শ্রেণীর গদ্য রচনার নামান্তর মাত্র –
তৎ কথাখ্যায়িকেত্যেকা জাতি সংজ্ঞাদ্বয়াঙ্কিতা’।
উভয় শ্রেণীর কাব্যে প্রভেদ কেবল আঙ্গিকে অর্থাৎ নিত্যান্ত বাহ্যিক। আভ্যন্তরীণ রচনারীতি কবির কাব্যরস সমৃদ্ধ শিল্প চেতনার দিক থেকে কোনো প্রভাব নেই।
কাদম্বরী কাব্যটি আখ্যায়িকা কাব্য নয়
◆ আমরা কাদম্বরীর বিষয়বস্তুকে অনুধাবন করে তার কাব্য স্বরূপ সমালোচনা প্রসঙ্গে মনে করতে পারি কাদম্বরী কাব্যটি আখ্যায়িকা কাব্য নয় এটি কথা কাব্যের লক্ষণের সঙ্গতি হয়েছে, যথা-
- ১) কাদম্বরী কাব্যের পূর্বভাগে মঙ্গলাচরণ প্রসঙ্গে কবি সম্রাট বান কাদম্বরী কাব্যের সূচনায় কবিতার মাধ্যমে ব্রহ্মা, শিব, গুরু, ভৎসুর উদ্দেশ্যে নমস্কার জানিয়েছেন এবং সৎকাব্যের জয়ধ্বনি করেছেন।
- ২) কাদম্বরী কথা কাব্যের একজন কেউ নায়ক নন এখানে কথাকাব্য টির বক্তাও নায়ক নিজে নন তিনটি ব্যক্তির মধ্যে মূলত কাব্যের বক্তিত বনিষ্টত হয়েছে। তারা হলেন বৈশম্পায়ন যিনি শুক পাখিতে শাপগ্রস্ত হয়ে পরিণত হয়েছিলেন।আর হলেন ত্রিকালজ্ঞ মুনিপ্রবর জাবালি। অপরজন হলেন মহাশ্বেতা।
- ৩) এই কাব্যের মধ্যে কবিবানের কাব্যরস যেমন শৃঙ্গার ভয়ানক বীভৎস প্রভৃতি উৎসারিত করার জন্য প্রনয় ভয়ঙ্কর ক্রোধ প্রভৃতি বিভাব তজ্জনিত অনুভাবগুলিকে প্রয়োগ করা হয়েছে। কাব্যের মাধুর্য বিস্তারের জন্য যথাযথভাবে উপমা অনুপ্রাস পরিসংখ্যা প্রভৃতি অলংকার সংযোজিত হয়েছে।
- ৪) কাদম্বরীরসজ্ঞানামাহারোঅপি ন রোচতে- কাদম্বরী সূরা স্বরূপ। সূরা সত্তা ব্যাক্তির কাছে যেমন অন্য খাবার রুচিকর হয়না, অনুরূপ” কাদম্বরী রসভরেন সমস্ত এব মত্তো ন কিঞ্চিদপি চেতয়তে জানোঅয়দ্। কাদম্বরী পাঠকের কাদম্বরী ব্যতীত অন্য কোন পুস্তক ভালো লাগেনা এই সেই কাদম্বরী যাতে শৃঙ্গার রসের ভিয়েনে কবি পাঠক ও শ্রোতাকে ভ্রমরের মতো আসক্ত করেছেন।
- ৫) এই কাব্যটি যদিও কথাসরিৎসাগর এর অনুকরণে বান কর্তৃক লিখিত তথাপি কাব্যটি কিন্তু কবির নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত। এতে কোনো ইতিহাস নেই।
- ৬) ভামহ, দন্ডী প্রভৃতিরা গদ্য কাব্যের একটানা বক্তব্যকে গদ্য কাব্যের বৈশিষ্ট্য রূপে স্বীকার করতে না চেয়ে পরিচ্ছেদের বিভাগ স্বীকার করেছেন কিন্তু এই সেই কাব্য কাদম্বরী যাতে একটানা বক্তব্য পরিদৃষ্ট হয়।অতএব এই রচনাটি আখ্যায়িকার অন্তর্গত নয।
- ৭) কন্যা লাভ এই কাব্যের ফলস্বরুপ এখানে একটি কন্যা লাভের কথা বলা হয়নি।দুই নায়ক এর দুটি কন্যা লাভের কথা -কাদম্বরী,মহাশ্বেতার কথা বলা আছে।
- ৮) শেষতঃ স্থানে স্থানে আর্যা,বক্ত্র,অপরবক্ত্র প্রভৃতি ছন্দে নির্মিত পদের সৎভাব কাদম্বরী কাব্যের মধ্যে লক্ষিত হয।অতএব এর থেকে আমরা প্রমান করতে পারি যে “কাদম্বরী’ কাব্য হল “কথা’ কাব্য।
আরো পড়ুন – কাদম্বরী সম্পর্কে পোস্টগুলি
- কাদম্বরী: শুকনাসোপদেশঃ( সংস্কৃত ব্যাখ্যা)
- কাদম্বরী: সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- ‘কাদম্বরী’ কথা না আখ্যায়িকা
- কাদম্বরী: চন্দ্রাপীড়ের প্রতি শুকনাসের উপাদেশাবলী
- বানভট্টকে অনুসরন করে মহাশ্বেতার রূপ বর্ণনা কর
- বাণভট্ট রচিত কাদম্বরী কথা না আখ্যায়িকা আলোচনা কর
- বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ – ব্যাখ্যা কর
- বাণোছিষ্টং জগৎ সর্বম্- কাদম্বরী পাঠ্যাংশের অনুসারে বর্ননা