তর্কসংগ্রহ হতে হেত্বাভাস বিষয়ে আলোচনা করা হল – হেত্বাভাস কাকে বলে? হেত্বাভাসের লক্ষণ ও প্রকারভেদ আলোচনা কর।
হেত্বাভাস কাকে বলে? হেত্বাভাসের লক্ষণ ও প্রকারভেদ আলোচনা কর
হেত্বাভাস কাকে বলে?
হেত্বাভাস বা শব্দের দোষদুষ্টকে বোঝায়। যা হেতু নয়, অথচ হেতু বলে প্রতীয়মান হয় তাই হল হেত্বাভাস- ” হেতোঃ আভাস ইতি হেত্বাভাসঃ”।
হেত্বাভাসের লক্ষণ
দীপিকায় শ্রীমদ অন্নংভট্ট হেত্বাভাসের সামান্য লক্ষণ দিয়ে বলেছেন-
” অনুমিতি প্রতিবন্ধক যথার্থ জ্ঞান বিষয়ত্বং হেত্বাভাসত্বম্।”
অর্থাৎ অনুমতির প্রতিবন্ধক যে যথার্থ জ্ঞান, সেই যথার্থ জ্ঞানের যে বিষয়, তাকে হেত্বাভাস বলে।
হেত্বাভাস শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ
হেত্বাভাস শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল- ” হেতুবদ্ আভাসতে = হেত্বাভাসঃ।” অথবা “হেতোঃ আভাসঃ = হেত্বাভাসঃ।” হেতু শব্দের অর্থ হল কোন একটি অনুমানের হেতু। আভাস শব্দের অর্থ হলো প্রতীয়মান হওয়া। অতএব হেত্বাভাস হল অনুমান সংক্রান্ত দোষ।
তর্কসংগ্রহের ন্যায় বোধিনী টীকায় গোবর্ধনমিশ্র এ প্রসঙ্গে বলেছেন-
” হেতুবদাভাসন্তে ইতি হেত্বাভাসা দুষ্টহেতব ইত্যর্থঃ।”
সুতরাং হেত্বাভাস শব্দের অর্থ দুষ্ট হেতু। হেতুর কোন কোন ধর্ম থাকলে এবং কোন কোন ধর্ম না থাকলে হেত্বাভাস হয়। তার্কিক বরদরাজ এ প্রসঙ্গে বলেছেন-
“হেতোঃ কেনাপি রূপেন রহিতা কৈশ্চিদন্বিতা।”
হেত্বাভাসের প্রকারভেদ
হেত্বাভাস পাঁচ প্রকার। যথা-
- ১) সব্যভিচার,
- ২) সব্যভিচার
- ৩) বিরুদ্ধ
- ৪) সৎপ্রতিপক্ষ
- ৫) বাধিত।
এ প্রসঙ্গে আচার্য অন্নংভট্ট প্রসঙ্গে বলেছেন-
” সব্যভিচার- বিরুদ্ধসৎপ্রতিপক্ষাঅসিদ্ধবাধিতাঃ পঞ্চ হেত্বাভাসাঃ।”
১) সব্যভিচার হেত্বাভাস:-
“ব্যভিচারেণ সহ বর্তমানঃ সব্যভিচারঃ”
অনুমানের নিয়ম অনুযায়ী যেখানেই হেতু, সেখানেই সাধ্য থাকবে । অর্থাৎ হেতুপদ সাধ্যপদের দ্বারা ব্যাপ্য হবে। কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলে সব্যভিচার হেত্বাভাস হয়। যেমন যেখানে ধূম (হেতু) থাকবে সেখানে সাধ্য (বহ্নি)ও থাকবে। এই নিয়ম লঙ্ঘিত হলেই সব্যভিচার নামক হেত্বাভাস হবে। এর অপর নাম অনৈকান্তিক হেত্বাভাস। গৌতম সূত্রে বলা হয়েছে – ‘অনৈকান্তিকঃ সব্যভিচারঃ’।অন্ত অর্থে নিশ্চয় আর একান্ত অর্থে যা নিয়ত নিশ্চিতরূপে বিদ্যমান। ঐকান্তিক বলতে যা নিশ্চিতরূপে সাধ্যধর্ম শূণ্য ও সাধ্যধর্ম বিশিষ্ট এই দুয়ের যে কোন একটিতে বিদ্যমান আর অনৈকান্তিক বলতে যা উভয় পদার্থেই বিদ্যমান। সব্যভিচার হেত্বাভাস আবার সাধারণ, অসাধারণ ও অনুপসংহারী ভেদে ত্রিবিধ-
” সাধারণাঅসাধারনাঅনুপসংহারিভেদাৎ।”
i) সাধারন সব্যভিচার:-
হেতুর ব্যাপকতা সাধ্যের ব্যাপকতার তুলনায় অধিক হলে সাধারণ সব্যভিচার দোষ হয়। যেহেতু সপক্ষেও থাকে আবার বিপক্ষেও থাকে সেই হেতুকে সাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস বলে-
” সাধ্যভাববৎবৃত্তিঃ সাধারনঃ অনৈকান্তিকঃ।”
যেমন- ‘পর্বতো বহ্নিমান্ প্রমেয়ত্বাৎ।” এই অনুমানের ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রমেয়ত্বাৎ (জ্ঞেয়ত্ব) হেতুটি সপক্ষ রান্নাঘরাদিতেও থাকে আবার বিপক্ষ (সাধ্যাভাবাবিশিষ্ট) হ্রদাদিতেও থাকে, তাই এটি সাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস।
ii) অসাধারন সব্যভিচার: –
যে হেতু সপক্ষে ও বিপক্ষে বর্তমান না থেকে হেতুটা কেবলমাত্র পক্ষে বর্তমান থাকে তাকে অসাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস বলে –
” সর্বসপক্ষবিপক্ষব্যাবৃত্তঃ পক্ষমাত্রবৃত্তিঃ অসাধারনঃ।
” যেমন- ‘ শব্দো নিত্যঃ শব্দত্বাৎ ইতি।” এই অনুমানের ক্ষেত্রে হেতু শব্দত্ব কেবল শব্দে থাকে তা সপক্ষ নিত্য পরমাণু ও আকাশাদিতেও থাকে না তাই শব্দত্ব এখানে হেতু নয়, অসাধারণ সব্যভিচার হেত্বাভাস।
iii) অনুপসংহারী সব্যভিচার হেত্বাভাস:-
যে হেতুর অন্বয়ী এবং ব্যতি কোন প্রকার দৃষ্টান্তই থাকে না। তাকে অনুপসংহারী সব্যভিচার হেত্বাভাস বলে-
” সর্বম্ অনিত্যং প্রমেয়ত্বাৎ।”
এখানে সকল বস্তুই পক্ষ শ্রেণীভূক্ত হওয়ায় সপক্ষ বা বিপক্ষ কোন প্রকার দৃষ্টান্তই পাওয়া যায় না।
এজন্য অন্নংভট্ট বলেছেন-
“অত্র সর্বস্যাপি পক্ষত্বাৎ দৃষ্টান্তো নাস্তি।”
এখানে হেতুকে কোন প্রকার দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করা যায় না।
২) বিরুদ্ধ হেত্বাভাস:-
পক্ষপদের মধ্যে সাধ্য পদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে হেতুপদ। যে অনুমানে হেতুপদ পক্ষে সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না। বরং সাধ্যের অস্তিত্বহীনতাই প্রমাণ করে, তাকে বলে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।
অন্নংভট্ট এর লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-
“সাধ্যাভাবব্যাপ্তো হেতুর্বিরুদ্ধ”।
যেমন- ‘শব্দো নিত্যঃ কৃতকত্বাৎ”- এই অনুমানে কৃতকত্বরূপ হেতুটা নিত্যত্ব রূপ সাধ্যের অনস্তিত্বই প্রমাণ করেছে, নিত্যত্ব কখনো কৃতকত্ব হয় না। বিরুদ্ধ হেতুর সপক্ষে কোন দৃষ্টান্ত থাকেনা, কিন্তু বিপক্ষে বহু দৃষ্টান্ত থাকতে পারে।
৩) সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস:-
সৎ শব্দের অর্থ হল আছে, আর প্রতিপক্ষ শব্দের অর্থ বিরোধী। অতএব, যে হেতুর বিরোধী অন্য হেতু আছে তাকে সৎ প্রতিপক্ষ বলে। কোনো অনুমান যখন সাধ্যের সাধক হেতুর প্রয়োগের ন্যায় সাধ্যাভাবের সাধক অন্য হেতুর প্রয়োগ হয় তাকে সৎপ্রতিপক্ষ হেত্বাভাস বলে। যেমন- ” শব্দো নিত্যঃ শ্রাবণত্বাৎ শব্দত্ববদিতি।” এই অনুমানে শ্রাবণত্ব হেতুটি শব্দের নিত্যত্বের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাইছে, আবার “শব্দোঅনিত্যঃ কার্যত্বাৎ ঘটবৎ”- এই অনুমানে কার্যত্ব হেতুটি পূর্বোক্ত অনুমানে সাধ্য নিত্যত্বের অভাব অনিত্যত্বই শব্দে আছে বলে প্রমাণ করতে চাইছে তাই কার্যত্ব হেতুটি শ্রাবণত্ব হেতুর প্রতিপক্ষ। ফলে শ্রাবণত্ব হল সৎ প্রতিপক্ষ হেত্বাভাস।
৪) অসিদ্ধ হেত্বাভাস:-
যে হেতুটি নিজেই সিদ্ধ বা প্রমাণিত নয়, সে কোনো সাধ্য নির্ণয় করতে পারে না বলে তাকে অসিদ্ধ হেতু বলে। যে অনুমানে সাধ্যের মত হেতু এবং পক্ষও অসিদ্ধ হয় তাকে অসিদ্ধ হেত্বাভাস বলে। “সাধ্যবিশিষ্টঃ সাধ্যতত্ত্বাৎ সাধ্যসমঃ।” (গৌতমের ন্যায় সূত্র) যেমন-“শব্দ অনিত্য চাক্ষুষত্বাৎ রূপবৎ”।
অসিদ্ধ হেত্বাভাসকে আবার তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- i) আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস,
- ii) স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস,
- iii) ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস।
i) আশ্রয়াসিদ্ধ :-
হেতপক্ষে থাকলে তবেই তার দ্বারা অনুমান সম্ভব। কিন্তু হেতুর আশ্রয় অর্থাৎ পক্ষটি যদি অলিক বা অবাস্তব হয় তবে তাতে হেতু থাকে পারে না বলে অনুমান সম্ভব নয়, সেই হেতুকে বলে আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস।
কৃষ্ণধূর্জটি সিদ্ধান্ত চন্দ্রদ্বয় টীকায় বলেছেন-
” পক্ষতাবচ্ছেদকাভাবকত্বই আশ্রয়াসিদ্ধ”
“গগনারবিন্দং সুরভি অরবিন্দত্বাৎ সরোজারবিন্দবৎ।”
এখানে গগনারবিন্দের কোন আশ্রয় বা অস্তিত্ব নেই তাই পক্ষও অসম্ভব বলেই আশ্রয়াসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়েছে।
ii) স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস:-
কোনো হেতুর পক্ষে থাকা সম্ভব না হলে সেই হেতুকে স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস বলে। ন্যায়বোধিনী টীকায় স্বরূপাসিদ্ধের লক্ষণে বলা হয়েছে-
” স্বরূপা সিদ্ধিনাসপমে হেত্বাভাস”
পক্ষে হেতুর অভাব থাকায় স্বরূপাসিদ্ধির লক্ষণ -” শব্দঃ গুনঃ চাক্ষুষত্বাৎ রূপবৎ”- এখানে চাক্ষুষত্ব হেতুটা শব্দরূপ পক্ষে থাকেনা। কারণ শব্দ শ্রবণেন্দ্রিয়গাহ্য, চক্ষুরিন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। অতএব, চাক্ষুষত্ব হেতু শব্দরূপ পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। পক্ষধর্মতার অভাব হেতু এখানে স্বরূপাসিদ্ধ দোষ হয়।
iii) ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস:-
যে হেতুতে ব্যাপ্তি অসিদ্ধ সেই হেতু ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ। তত্ত্বচিন্তামণি এবং ভাষা পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যদি হেতুটি ব্যর্থ বিশ্লেষণ ঘটিত হয় তাহলে ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়। যেমন- ‘ পর্বত বহ্নিমান’ – এই অনুমানে হেতু ধূমের ‘নীলধূমাৎ’ নীলত্ব বিশ্লেষণটি ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাপ্যতাসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়েছে।
v) বাধিত হেত্বাভাস:-
কোন অনুমানের হেতু যদি অন্য কোনো প্রমাণ এর দ্বারা বা যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা ভুল বলে প্রমাণিত হয় তাহলে সেই অনুমানটিকে বাধিত হেত্বাভাস বলে।
অন্নংভট্ট এর লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-
” যস্য সাধ্যাভাব প্রমাণান্তরেণ নিশ্চিতঃ স বাধিতঃ”।
যেমন- ‘বহ্নিবনুষ্ণো দ্রব্যত্বাৎ’- এখানে অনুমান বাক্যটিতে বহ্নিপক্ষ, অনুষ্ণ সাধ্য এবং দ্রব্যত্ব হেতু। এখানে হেতু (দ্রব্যত্ব) পক্ষে (বহ্নিতে) সাধ্যের (অনুষ্ণতার) প্রমাণ করতে চায়, কিন্তু প্রত্যক্ষের দ্বারাই বহ্নিতে সাধ্যাভাব অর্থাৎ অনুষ্ণতার অভাব প্রমাণিত হয় বলে অনুমানটিকে বাধিত হেত্বাভাস বলে।