তর্কসংগ্রহ হতে আত্মা সম্পর্কে টিকা লেখ ।
টিকা আত্মা – তর্কসংগ্রহ
আত্মা:- ন্যায় বৈশেষিক আচার্য মহামহোপাধ্যায় অন্নংভট্ট দ্রব্যের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন-
” দ্রব্যত্বজাতিমত্ত্বং গুণবত্ত্বং বা দ্রব্যসামান্যলক্ষণম্।”
অর্থাৎ জাতিমান বা গুনবান পদার্থই দ্রব্য। আবার
“তত্র দ্রব্যাণি পৃথিব্যপ্তেজোবায়্বাকাশকালদিগাত্মমনাংসি নবৈব।”
অর্থাৎ পৃথিবী, অপ, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মাও মন- এই নববিধ দ্রব্যের মধ্যে আত্মা হল অন্যতম।
আত্মার লক্ষণ প্রসঙ্গে অন্নংভট্ট বলেছেন-
” জ্ঞানাধিকরণমাত্মা।”
অর্থাৎ জ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়কেই আত্মা বলে।
জ্ঞান সমবায় সম্বন্ধে কেবলমাত্র আত্মাকেই থাকে। তাই জ্ঞান কালে কালিক সম্বন্ধে থাকলেও লক্ষণটি অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট নয়। কিন্তু মুক্ত আত্মাতে অব্যাপ্তি আশঙ্খা হয়। কারণ ন্যায় বৈশেষিক মতে, মুক্ত আত্মাতে জ্ঞান থাকেনা। এর উত্তরে বলা যায়, জ্ঞানের অধিকরণই আত্মা বলে যেখানে যেখানে জ্ঞান থাকে, সেখানে সেখানে আত্মা অবশ্যই আছে। কিন্তু যেখানে যেখানে আত্মা আছে সেখানে সেখানে জ্ঞান নাও থাকতে পারে। অতএব, আত্মার উক্ত লক্ষণটি লক্ষ্যতাবচ্ছেদকের সমনিয়ত না হওয়ায় ব্যবহারিক লক্ষণমাত্রই হয়েছে। সুতরাং এখানে জ্ঞানাধিকরণ বলতে জ্ঞানের সমানাধিকরণ দ্রব্যত্বের যে অপর বা ব্যাপ্য জাতি, সেই জাতির অধিকরণকে বোঝায়। এটিই হল আত্মত্ব জাতি। আত্মত্ব জাতি লক্ষ্যতাবচ্ছেদকের সমনিয়ত ধর্ম হওয়ায় অব্যাপ্তি দোষ থাকে না।
আচার্য অন্নংভট্ট জীবাত্মা পরমাত্মা ভেদে আত্মাকে দুভাগে ভাগ করেছেন-
” স দ্বিবিধঃ জীবাত্মা পরমাত্মা চ ইতি।”
পরমাত্মাই ঈশ্বর। তিনি সর্বজ্ঞ এবং এক। কিন্তু জীবাত্মা অনেক এবং প্রতি শরীরে ভিন্ন ভিন্ন। বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্ত্তাকে ঈশ্বর বা পরমাত্মা বলে। পরমাত্মার লক্ষণ করতে গিয়ে অন্নংভট্ট বলেছেন-
” নিত্যজ্ঞানাধিকরণত্বমীশ্বরত্বম্।”
অর্থাৎ নিত্য জ্ঞানের অধিকরণই পরমাত্মা। যে জ্ঞানের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই, তাকে নিত্যজ্ঞান বলে। ঈশ্বর বা পরমাত্মা সর্বদা সর্ব বিষয়ে জ্ঞানবান্। কোন কিছুই তাঁর অগোচর নাই। তাই তিনি সর্বজ্ঞ।
আত্মার অপর ভেদটি জীবাত্মা। এর লক্ষণ প্রসঙ্গে অন্নংভট্ট বলেছেন-
” জীবস্তু প্রতিশরীরং ভিন্নো বিভু নির্ত্যশ্চ”
অর্থাৎ জীবাত্মা সুখ, কটি দেহে পৃথক পৃথক কিন্তু বিভু ও নিত্য। সুখ, দুঃখ ইত্যাদি যে অধিকরণে সমবায় সম্বন্ধে থাকে তাকেই অন্ধ ইত্যাদি অনুভব সকলেরই হয়ে থাকে। তাই সুখ দুঃখাদির কারণতাবচ্ছেদক আত্মত্ব জাতিই আত্মার লক্ষণ।
সুতরাং জীবাত্মাকে পরম মহৎ পরিমাণ বিশিষ্ট অর্থাৎ বিভু স্বীকার করাই যুক্তিযুক্ত। দেহের বিনাশ হলেও জীবাত্মার বিনাশ হয় না। তাই পরজন্মে জীবাত্মা নতুন দেহ ধারণ করে পূর্বজন্মকৃত যে সকল কর্মের ফল ভোগ হয়নি সে সমস্ত কর্মের ফলভোগ করে।
বিভু পরিমাণ আকাশ, কাল, দিক, প্রভৃতির মত একই যুক্তিতে আত্মাকে নিত্যবস্তু রূপে স্বীকার করতে হয়। অতএব জীবাত্মা নিত্য ও বিভু।