কথা ও আখ্যায়িকা:- ‘কাদম্বরী’ কথা না আখ্যায়িকা
কাদম্বরী কথা না আখ্যায়িকা
কাব্য রচনায় কবির কবিত্ব প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের কোষ্ঠিপাথর। তাই বলা হয়ে থাকে-
‘গদ্যং কবীনাং নিকষং বদন্তি।’
কাব্যকে আবার দৃশ্য ও শ্রব্য ভেদে দুভাগে ভাগ করা যায়।
দৃশ্য কাব্যের আবার দুইপ্রকার ভেদ রয়েছে। যথা- i) রূপক ও ii) উপরূপক। শ্রব্য কাব্যকে আবার গদ্য, পদ্য ও মিশ্র এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। কাব্যের স্বরূপ নির্ণয় প্রসঙ্গে আচার্য দণ্ডী বলেছেন-
” অপাদঃ পদসন্তানো গদ্যম্।”
অর্থাৎ পাদবিহীন অর্থ সমন্বিত পদসন্নিবেশই গদ্য।
এই গদ্যকাব্যের বহু অবান্তর ভেদ পরিলক্ষিত হয়। যেমন- কথা, আখ্যায়িকা, খন্ডকথা, পরিকাথা ও কথালিকা। তাই অগ্নি পুরাণ -এ বলা হয়েছে –
” আখ্যায়িকা কথা খন্ডকথা পরিকথা তথা
কথালিকেতি মন্যন্তে গদ্যকাঞ্চ পঞ্চধা।।”
অর্থাৎ উপরিউক্ত পাঁচটি বিভাগের মধ্যে কথা ও আখ্যায়িকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আলংকারিকেরা মূলত আখ্যায়িকা ও কথার স্বরূপকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপনা করেছেন।
কথা ও আখ্যায়িকার স্বরূপ নির্ণয়ে বিভিন্ন আলংকারিকগণের মতামত
সুতরাং আমাদের পাঠ্যাংশে ‘কাদম্বরী’ কথা না আখ্যায়িকা এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে কথা ও আখ্যায়িকার স্বরূপ নির্ণয়ে বিভিন্ন আলংকারিকগণের স্বরূপ নির্ণয়ে বিভিন্ন আলংকারিকগণের মতামত পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
ভামহ:-
আখ্যায়িকার বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে খ্রীষ্টিয় সপ্তম শতাব্দির আলংকারিক ভামহ তাঁর কাব্যালংকার গ্রন্থে বলেছেন-
- i) আখ্যায়িকার বিষয়বস্তু লোকানুবর্তি বা সাধারন মানুষের গ্রহণযোগ্য হবে-
- ” প্রকৃতানুকুলশ্রব্যশব্দার্থ পদবৃত্তিনা।”
- ii) নায়ক নিজেই এই আখ্যানভাগের বক্তা হবে। -” বৃত্তমাখ্যায়তে তস্যাং নায়কেন স্বচেষ্টিতম্।”
- iii) আখ্যান ভাগটি সহজ সরল গদ্যে রচিত হবে।
- iv) গল্পটিতে পরিচ্ছেদ, বিভাগ থাকবে। পরিচ্ছেদকে পরিচ্ছেদ না বলে উচ্ছ্বাস বলতে হবে।
- v) কন্যা হরন, যুদ্ধ, বিগ্রহ, বিরহ ইত্যাদি কবি কল্পনার মাধ্যমে নায়কের অভ্যুদয় প্রদর্শিত হবে-
- ” কবেরভিপ্রায়কৃতৈরঙ্কনৈঃ কৈশ্চিদঙ্কিতা
- কন্যাহরণ সংগ্রাম বিপ্রলম্ভোদয়ান্বিতা।।”
- vi) আখ্যায়িকার ভাষা মূলত সংস্কৃত হবে।
- vii) মাঝে মাঝে বক্স ও অপরবক্স ছন্দে ভাবী ঘটনা সূচক শ্লোক থাকবে-
- ” বক্র চাপরবক্রঞ্চ কালে ভাব্যর্থশংসি চ।”
অপরদিকে, আলংকারিক ভামহ কথাকাব্যের স্বরূপ প্রসঙ্গে বলেছেন-
- i) কথা কাব্যের বক্র, অপরবক্র ছন্দের প্রয়োগ থাকবে না, উচ্ছ্বাস বিভাগ থাকবে না –
- ” ন বক্রাপরবক্রাভ্যাং যুক্তা নোচ্ছ্বাসবত্যপি।”
- ii) এর কাহিনীর বক্তা হবেন নায়ক ব্যতীত অন্য কেউ- “অন্যৈ স্বরচিতং তস্যাং নায়কেন তু নোচ্যতে।
- iii) এর উচ্ছ্বাস ভাগ থাকবে না, সুতরাং গল্পে অবিরল প্রবাহ চলতে থাকবে।
- iv) কথাকাব্যের বিষয়বস্তুর ভাষা সংস্কৃত ছাড়া অপভ্রংশ ভাষায় রচিত হবে-
- ” সংস্কৃতং সংস্কৃতা চেষ্টা কথাপভ্রংশভাক্ তথা।।”
অগ্নিপুরাণ:-
আখ্যায়িকার লক্ষণ প্রসঙ্গে অগ্নি পুরাণে বলা হয়েছে –
i) গদ্যে কবির বংশের প্রশংসা থাকবে।
ii) কন্যা হরণ, যুদ্ধ, বিপ্রলম্ভ প্রভৃতি প্রতিকূল ঘটনা থাকবে।
iii) উচ্ছ্বাস ভাগ থাকবে।
iv) বৃত্তিরীতির ব্যবহার থাকবে।
অপরদিকে, কথাকাব্যের লক্ষণ প্রসঙ্গে অগ্নিপুরাণে বলা হয়েছেন-
i) পদ্যে কবির প্রশংসা থাকবে।
ii) মূল কাহিনীর সাথে উপকারিণীর সংযোজন থাকবে।
iii) পরিচ্ছেদ বা লম্ভবিভাগ থাকবে।
iv) প্রতি গর্ভে চতুষ্পদী কবিতার প্রয়োগ থাকবে।
দণ্ডী:-
আচার্য দণ্ডী তার কাব্যাদর্শ কোন ভেদ স্বীকার না করেই বলেছেন-
“কথামাখ্যায়িকেত্যেকাজাতিঃ সংজ্ঞাদ্বয়াঙ্কিতা।”
অর্থাৎ কথা ও আখ্যায়িকা একেই জাতের পার্থক্য কেবলমাত্র নামের। আলংকারিক বামন দণ্ডীর এই মতকে স্বীকার করেছেন।
অমর সিংহ:-
অমর সিংহের মতে-
” আখ্যায়িকোপলধ্বর্থা, প্রবন্ধ কল্পনা কথা।”
অর্থাৎ উপলব্ধ বা ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে নিয়ে রচিত গদ্য কাব্যকে আখ্যায়িকা এবং সম্পূর্ণরূপে কবি কল্পিত বিষয় বস্তু অবলম্বনে রচিত গদ্য কাব্য হল কথা। শব্দ কল্পদ্রুমে আখ্যায়িকা ও কথার বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
” আখ্যায়িকা উপলব্ধার্থ কথা প্রবন্ধ কল্পনা।”
সুতরাং আখ্যায়িকাই ইতিহাস বা উপন্যাস আর কথা কাল্পনিক রচনা।
বিশ্বনাথ:-
আলংকারিক বিশ্বনাথ কবিরাজ সাহিত্য দর্পন গ্রন্থে কথা কাব্যের লক্ষণ বলেছেন- “কথায়াং সরসং বস্তু রচিত হবে সরস, গদ্যময়, কোথাও কোথাও বক্র, আর্য্যা, অপরবক্রে ছন্দে রচিত পদ্য থাকবে। গ্রন্থারম্ভে পদ্য রচনার দ্বারা ইষ্ট দেবতার স্তুতি, দুজন ব্যাক্তির নিন্দা ও সাধু ব্যাক্তির প্রশংসা থাকবে। অপরদিকে, আখ্যায়িকার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
” আখ্যায়িকা কথা স্যাৎ কবের্বংশানুকীর্ত্তণম্।
তস্যামন্যকবীণাঞ্চ বৃত্তং পদ্যং ক্বচিৎ ক্বচিৎ।।”
অর্থাৎ আখ্যায়িকাতে কথার মত কবির বংশ বর্ণনা থাকবে। অন্য কবিদের বৃত্তান্তও থাকবে। মাঝে মাঝে পদ্য থাকবে, অধ্যায় গুলো আশ্বাস নামে অভিহিত হবে। “কথাংশানাং ব্যবচ্ছেদ আশ্বাস ইতি কথ্যতে।”
আর্য্যা, বক্র ও অপরবক্র যে কোনো একটি ছন্দে আশ্বাসের প্রারম্ভে ভাবী বিষয়ের সূচনা হবে-
” অন্যাপদেশেনাথাশ্বাসমুখে ভাব্যার্থসূচনম্।।”
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কাদম্বরী কথা কাব্যের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রথমেই মহাকবির উক্তি-
“রজোজুসে জন্মনিসত্ত্ব বিওয়ে স্তিতৌ প্রজানাং প্রলয়েতমঃ স্পৃশৌ। ‘
কাদম্বরীর নান্দীশ্লোকে অভীষ্ট দেবতাকে নমস্কার জানিয়ে উত্তম কাব্যের ফলশ্রুতি ও কবির বংশ পরিচয় আছে। অপরদিকে, কাদম্বরী কাব্যের বক্তা নায়ক চন্দ্রাপীড় নন, বক্তারা হলেন বৈশম্পায়ণ, মহাশ্বেতা এবং জাবালি ঋষি। কাদম্বরী কাব্যটি একটানা রচনা, এতে কোন উচ্ছ্বাস ভাগ নেই। কাব্যটিতে মাঝে মাঝে আর্য্যা, বক্র, অপরবক্র ছন্দ লক্ষণীয়। অতএব কাদম্বরী নিঃসন্দেহে কথাকাব্য।
আরো পড়ুন – কাদম্বরী সম্পর্কে পোস্টগুলি
- কাদম্বরী: শুকনাসোপদেশঃ( সংস্কৃত ব্যাখ্যা)
- কাদম্বরী: সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- ‘কাদম্বরী’ কথা না আখ্যায়িকা
- কাদম্বরী: চন্দ্রাপীড়ের প্রতি শুকনাসের উপাদেশাবলী
- বানভট্টকে অনুসরন করে মহাশ্বেতার রূপ বর্ণনা কর
- বাণভট্ট রচিত কাদম্বরী কথা না আখ্যায়িকা আলোচনা কর
- বানোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্ – ব্যাখ্যা কর
- বাণোছিষ্টং জগৎ সর্বম্- কাদম্বরী পাঠ্যাংশের অনুসারে বর্ননা