শিবিজাতকম্ এই উপাখ্যানের তাৎপর্য সংযোজিত করে আখ্যানের দান মহিমা প্রদর্শন কর।
শিবি জাতক উপাখ্যানের তাৎপর্য সংযোজিত করে দান মহিমা প্রদর্শন
আরো পড়ুন জাতকমালা হতে প্রশ্ন উত্তর গুলি –
- জাতকমালা: ব্যাঘ্রীজাতকম্ উপখ্যানের কাহিনী
- জাতকমালা: শশজাতকম্ উপখ্যানের তাৎপর্য
- জাতকমালা: অবিষহ্য শ্রেষ্ঠিজাতকম্ এই উপাখ্যানের সারবস্তু বর্ণনা করে দানসম্পর্কে আলোচনা
- জাতকমালা: কুল্মাষপিণ্ডীজাতকম্ উপাখ্যানের নৈতিক শিক্ষার মূল্যায়ন
- জাতকমালা: শিবি জাতক এই উপাখ্যানের তাৎপর্য সংযোজিত করে দান মহিমা প্রদর্শন
উ:- আর্যশূর রচিত জনপ্রিয় জাতকমালা গ্রন্থে পারমিতা বা বোধিসত্ত্বের পূর্ণতালাভের উদাহরণ প্রসঙ্গে ৩৪টি পুরাতন জাতকের কাহিনী নতুন কাব্যরসে সঞ্জীবিত করে পরিবেশন করা হয়েছে। গ্রন্থটি গদ্য ও পদ্যে মিশ্র চম্পূকাব্যের রীতিতে রচিত। কালিদাস পূর্বযুগের সংস্কৃতে রচিত বৌদ্ধসাহিত্যের দুটি ধারা- পদ্য ও গদ্য। পদ্য সাহিত্যের মধ্যে প্রধান হল অবদান-গ্রন্থমালা( অবদানশতক, দিব্যাবদান ইত্যাদি। ) গদ্য সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহাবস্তু ও ললিতাবিস্তুর। পালিভাষায় রচিত জাতকের গল্পের অনুসরনে সংস্কৃতে যে বৌদ্ধ গল্পসাহিত্য গড়ে ওঠে, অবদানগ্রন্থমালা তারই অন্তর্গত। বৌদ্ধসাহিত্যের মধ্যে জাতকগুলির বিশেষ একটা স্থান আছে। বৌদ্ধ মতে, নানা জন্মে জীবনে বহু বিচিত্র পারমিতা বা পূর্ণতা লাভের অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়েই বুদ্ধদেব পূর্ণত্ব বা অভিসম্বুদ্ধত্ব লাভ করেন। অভিসম্বুদ্ধ মাত্রেই জাতিস্মর বলে সেই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী গৌতম শিষ্যদের ধর্মোপদেশ দেবার সময়ে তাঁর অতীত জীবনের নানা কাহিনী বলতেন, এই কাহিনী গুলিই জাতককাহিনী নামে পরিচিত এবং বৌদ্ধধর্মশাস্ত্রের নব অঙ্গের এক অঙ্গরূপে এবং সূত্তপিটকের খুদ্দনিকায়ের একটা শাখারূপে পরিগণিত হয়েছে। গল্পের মাধ্যমে জনসাধারনকে মানবজীবন, সমাজ ও আচরনবিধি শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যেই জাতকগুলি রচিত হয়েছে। জাতকের মূল বস্তু হল গল্প, তারপর তারপর ধর্মোপদেশের রচিত হয়েছে। জাতকের মূল বস্তু হল গল্প, তারপর ধর্মোপদেশের স্থান। জাতক কাহিনীগুলির মাধ্যমে বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। ভগবান বুদ্ধের দানশীলতার চরম পরাকাষ্ঠার নিদর্শন আমরা শিবিজাতক কাহিনী থেকে পেয়ে থাকি।
শিবি জাতক উপাখ্যানের দান মহিমা প্রদর্শন
সুদূর অতীতকাল থেকে মহান কার্যাবলী অনুষ্ঠানে তৎপর বোধিসত্ত্ব একসময় শিবিদের রাজা হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদ্যমী, দূরদর্শী, বিনয়ী, শ্রদ্ধাশীল, জ্ঞানী, সর্বোপরি মহান দাতা-
” উদারভাবাৎকরুণাগুণাচ্চ বিত্তাধিপত্যাচ্চ স রাজবর্মঃ।
রেমেঅর্থিনামীপ্সিতসিদ্ধি হর্ষাদক্লিষ্টশোভানি মুখানি পশ্যন্।।”
রাজা তাঁর সহজাত দানশীলতার জন্য নগরের বিভিন্নস্থানে দানছত্র নির্মান করেছিলেন। সেখানে সবরকম আসবাব, শয্যাদি ও অন্যান্য বস্তুসামগ্রী যাচকেরা তাদের প্রয়োজন ও ইচ্ছা অনুযায়ী সংগ্রহ করত। ভিক্ষ্যার্থী বা যাচক তাদের অভিলাষিত বস্তুর প্রাপ্তিতে সন্তোষলাভ করে ফিরে গেলেও রাজার দানের ইচ্ছা বা আকাঙ্খার নিবৃত্তি হতনা। দানের সংকল্প এমন দৃঢ়ভাবে রাজাকে বেষ্টন করে রেখেছিল যে, তিনি তাঁর নিজের অঙ্গ-প্রতঙ্গ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন-
” দানাতিহর্ষোদ্ধতমানসেন বিতর্কিতং কিং স্বিদিদংনৃপেন।
আবধ্য দানব্যবসায়কক্ষ্যাং স্বগাত্রদানস্থিরনিশ্চয়েন।।”
একসময় দেবরাজ ইন্দ্র বৃদ্ধ এবং অন্ধ ব্রাহ্মণ বেশে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে রাজার নিকট একটি চক্ষু প্রার্থনা করলেন তার অন্ধত্ব নিবারনের জন্য। বোধিসত্ত্ব আনন্দে আপ্লুত হয়ে ব্রাহ্মণ কে আশ্বস্ত করলেন যে একটি চক্ষুর পরিবর্তে তিনি তার দুটি চোখ ব্রাহ্মণকে দান করবেন। কারণ অবয়বদানের জন্য তিনি বহু কাল থেকেই প্রস্তুত হয়ে আছেন। অতঃপর চক্ষুদান প্রক্রিয়া সমাপ্ত হলে ব্রাহ্মণ তার হৃত দৃষ্টি পুনরায় ফিরে পেলেন এবং রাজা তাঁর পরিষদবর্গের অনুরোধ উপেক্ষা করে অন্ধত্বকে আনন্দের সঙ্গে বরণ করে নিলেন। এদিকে রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরে এবং নগরের চারদিকে দুঃখাশ্রু বর্ষিত হতে থাকল। রাজার এই মহান দানশীলতা দেবরাজ ইন্দ্রকে রাজার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বিস্মিত করে তুলেছিল-
” অহো ধৃতিরহো সত্ত্বমহো সত্ত্বহিতৈষিতা।
প্রত্যক্ষমপি কর্মেদং করোতীব বিচারণম্।।”
ইন্দ্র ভাবলেন যে অপরের কল্যাণের জন্য এই আত্মত্যাগ ইকে দীর্ঘকাল অন্ধত্বের কস্ট বহন করতে দেওয়া উচিত হবেনা ইন্দ্র একসময় রাজার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে রাজাকে বর প্রার্থনা করতে বললেন রাজা বললেন যে চক্ষু না থাকায় তিনি শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন মুখ দর্শনের বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছে আর এই অবস্থায় মৃত্যু তার কাছে একমাত্র কাম্য-
” প্রভৃতং মে ধনং শক্র শক্তিমচ্চ মহদ্বলম্।
অন্ধভাবাত্ত্বিদানীং মে মৃত্যুরেবাভিরোচতে।।”
রাজার এই সত্যবাদিতা ও মহান কার্যের ফলস্বরূপ ইন্দ্র তাঁর দুটি চক্ষু ফিরিয়ে দিলেন, যে চক্ষুদ্বয়ের মধ্যমাংশ ইন্দ্রনীলমনির অংশবিশেষ সংলগ্ন-
” ন নো ন বিদিতো রাজস্তব শুদ্ধাশয়াশয়ঃ
এবং নু প্রতিদত্তে তে ময়েমে নয়নে নৃপ।।”
এই দিব্যচক্ষু সাহায্যে রাজা শত যোজন দূরে অবস্থিত বস্তু এমনকি পর্বতের পশ্চাদদেশে অবস্থিত বস্তু সকলও দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শিবি জাতক উপাখ্যানের তাৎপর্য:-
এই উপাখ্যানে যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। এগুলো নিম্নলিখিত-
- i) যে রাজলক্ষ্মী দুর্বিনীতের নিকটে উপহাসের কারণ হয়, মূর্খের নিকটে নিদারুণ বিপত্তির কারণ হয়, অসংযমীর নিকটে মদিরার মতো হয়, সেই লক্ষ্মী বোধিসত্ত্বের নিকটে এসে সার্থক-নামা অর্থাৎ সুখের কারণ হয়েছে।
- ii) বিদেশ থেকে আগত বন্ধুকে যেমন হৃদ্যতার সঙ্গে অভ্যর্থনা করা হয়, তেমনি ভিক্ষুকদের সমাদরে গ্রহণ করা উচিত।
- iii) দান থেকে উদ্ভূত যে কীর্তিরূপ সুগন্ধ, যাচকদের বাণীরূপ বাতাসের দ্বারা তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
- iv) কোন দানের দ্বারা অন্তরে এমন আনন্দ লাভ করা যায়, যার দ্বারা উদারচেতা হওয়া যায়।
- v) কোন জিনিস দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে যে ব্যক্তি তার সংকল্পের পরিবর্তন করে সে কার্পণ্য দোষ লিপ্ত হওয়ার কারণেই নিজের প্রতি জ্ঞা ভঙ্গ করে, অতএব সে একজন জঘন্যতম মানুষের পর্যায়ে পড়ে-
“দাস্যমীতি প্রতিজ্ঞায় যোহন্যথা কুরুতে মনঃ।
কার্পণ্যানিশ্চিতমতেঃ কঃ স্যাৎপাপতরস্ততঃ।।”
- vi) যে ব্যক্তি ভিক্ষুকদের দানের প্রতিজ্ঞা করে তাদের আশাকে নিশ্চিত করে। কিন্তু পরে কঠোর বিরোধী বচনের দ্বারা তাদের প্রত্যাখ্যান করে। সেই ব্যক্তি কখনো অন্যায় কার্য থেকে মুক্তি পেতে পারে না।
- vii) বিনয় এবং জীবদয়া থেকে উদ্ভূত দানের থেকে বড়ো অভ্যুদয় বা মঙ্গলের কি উপায় থাকতে পারে। যেহেতু মনুষ্যক্ষে দান করার ফলে দিব্যচক্ষু ইহলোকেই লাভ করা যায়।
- viii) দান ও ব্যয়ে সম্পত্তিকে বিনিয়োগ পূর্বক তার সফলতা আনয়ন করা উচিত। ইহলোকে ও পরলোকে সুখ প্রাপ্তির এটাই একমাত্র পথ।
- ix) অর্থ হচ্ছে এক অসার পদার্থ এবং ঘৃণ্য জিনিস। তথাপি সেই অর্থকে লোকহিতকর কার্যে যদি নিয়োগ করা হয়, তবে তা এক মহামূল্য বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। কারণ যা কিছু দান করা হয় তা ক্রমে বর্ধিত হতে থাকে, আর যদি নিজ স্বার্থে অর্থ ব্যয় করা হয় তবে সেই অর্থ নষ্ট হয়।