২) শব্দ ও অর্থের সম্বন্ধ নিত্য – বাক্যপদীয় গ্রন্থ অবলম্বনে আলোচনা কর।
বাক্যপদীয় গ্রন্থ অবলম্বনে আলোচনা – শব্দ ও অর্থের সম্বন্ধ নিত্য
উ:- শব্দ, অর্থ ও তাদের সম্বন্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বার্তিককার কাত্যায়ন বলেছেন-“সিদ্ধে শব্দার্থসম্বন্ধ। সিদ্ধ শব্দটি নিত্য শব্দের পর্যায়বাচক শব্দ এবং বাক্যস্থ তিনটি পদের সঙ্গেই তার অন্বয় হবে।
শব্দ ও অর্থের সম্বন্ধ নিত্য
পাণিনী তাঁর অষ্টাধ্যায়ীগ্রন্থ -এ শব্দকে নিত্য বলে স্বীকার করেছেন। নিত্য শব্দের দ্বারা বাচ্য যে অর্থ (শব্দার্থ) তাকেও নিত্য হতে হবে। তা না হলে শব্দের নিত্যত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না। সম্বন্ধিদ্বয় নিত্য হলে তার সম্বন্ধ অনিত্য হতে পারে না। বাক্যপদীয়কারও যে এই মত সমর্থন করেন, তা তাঁর কারিকাটিতেই সুস্পষ্ট। কারিকাটি হল-
” নিত্যাঃ শব্দার্থসম্বন্ধস্তত্রাম্নাতা মহষিভিঃ।
সূত্রাণামনুতস্ত্রাণাং ভাষ্যানাঞ্চ প্রণেতৃভিঃ।।” (বাক্যপদীয় ১/২৩)
সূত্রকার,বার্তিককার এবং ভাষ্যকার পাণিনীয় সম্প্রদায়ের মূর্দ্ধণ্য এই তিনজন আচার্য যাঁরা মুনিত্রয় রূপে পরিগণিত হয়ে থাকেন এবং যাদের নামানুসারে পাণিনী ব্যাকরণ ‘ ত্রিমুণি ব্যাকরণ ‘ রূপে পরিচিত। তারা যে সকলেই শব্দ,অর্থ ও তাদের সম্বন্ধের নিত্যতা বিষয়ে একমত- এটা সূচনা করার জন্য আম্নাত শব্দটি কারিকায় প্রয়োগ করা হয়েছে। আম্নাত অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ক্রমে যা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় অনুশিষ্ট হয়ে আসছে। সিদ্ধে শব্দার্থসম্বন্ধে-এই প্রথম বার্তিকে এবং তার আলোচনাবসরে পস্পশা আহ্নিকে ভাষ্যকার অতি বিস্তৃত ভাবে শব্দ,অর্থ ও সম্বন্ধের নিত্যতা সম্বন্ধে বিচার করেছেন।
শব্দ বলতে এখানে শব্দজাতি বা শব্দাকৃতি(ঘট শব্দত্ব ইত্যাদিরূপ) অর্থ বলতে অর্থাকৃতি বা অর্থজাতি (ঘট-ত্বা দি রূপ) বুঝতে হবে। কেননা শব্দ ব্যক্তি অর্থাৎ প্রতিটি উচ্চমান শব্দ পুরুষভেদে, কালভেদে, অবস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন এবং উৎপাদ- বিনাশ শীল, সুতরাং অনিত্য, যার উৎপত্তি নেই, বিনাশ নেই,তাকেই নিত্য বলা হয়।
অনুরূপভাবে ঘটাদি ইত্যাদি অর্থও ব্যক্তিরূপে ভিন্ন ভিন্ন ও অনিত্য। কিন্তু জাতিরূপে তা নিত্য। অর্থাৎ জাতিতে শক্তি স্বীকার করাই সঙ্গত হয়। ব্যক্তিতে শক্তি স্বীকার করা নির্দোষ নয়। দৃষ্টান্তরূপ বলা যায় যে, পৃথিবীতে গো ব্যাক্তি অনন্ত। অতীতে কত গো ব্যাক্তি ছিল, বর্তমানে কত গো ব্যাক্তি আছে, ভবিষ্যতেই বা কত গো ব্যক্তি হবে, কে তার ইয়ত্তা করতে পারে? প্রতিটি গো ব্যাক্তিতে যদি শক্তি স্বীকার করা হয় তাহলে শক্তিও অনন্ত হবে। জাতিতে শক্তি স্বীকার করলে অনন্ত শক্তি স্বীকার করতে হয় না, কারণ গো ব্যক্তি অনন্ত হলেও গোত্ব
জাতি একটি।
শব্দ ও অর্থের নিত্যত্ব
এখন প্রশ্ন ওঠে যে, শব্দকে অর্থাৎ শব্দ জাতিকে নিত্য বলে স্বীকার করলে শব্দের বাচ্যার্থও কি নিত্য হবে? শব্দ, নিত্য, কিন্তু তার অর্থ অনিত্য হলে শব্দের নিত্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না। এজন্য শব্দের নিত্যতা স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থের নিত্যতা স্বীকারও অপরিহার্য। শব্দ অর্থ বিচ্ছিন্ন, অর্থ শব্দ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। অন্যটি যেহেতু শব্দের অর্থ, এজন্য ওদের সম্বন্ধ অবশ্য স্বীকার করতে হবে এবং সেই সম্বন্ধকেও নিত্য বলতে হবে।
শব্দ ও অর্থের নিত্যত্ব শুধু জাতি পক্ষ স্বীকারের দ্বারাই সম্ভব। তাছাড়া যদি শব্দ ও অর্থ ব্যক্তি -কেই বোঝায়, তবে তাদের মধ্যে সম্বন্ধও নিত্য হতে পারেনা। জাতিকেই যদি শক্ত বা বাচক বলা যায়, এবং জাতিই যদি শক্য বা অর্থ বা অভিধেয় বা বাচ্য হয়, তবেই তাদের সম্বন্ধও নিত্য হতে পারে, অন্যথা নয়। সম্বন্ধিদ্বয় নিত্য হলে তাদের সম্বন্ধ অনিত্য হতে পারে না। সেই কারণেই সিদ্ধে শব্দার্থসম্বন্ধে -এই বার্তিকের দ্বারা শব্দ, অর্থ ও সম্বন্ধের নিত্যত্বের কথা বললেন। সিদ্ধ পদের দ্বারা যে তিনি নিত্যতাকেই বুঝিয়েছেন তা ‘সিদ্ধং তু নিত্যশব্দত্বাৎ’ এই বার্তিক থেকেই প্রমাণিত হয়।