মেঘদূতম্ কাব্যে বর্ণিত অলকানগরীর বর্ণনা দাও। কবির বর্ণনা শক্তির পরিচয় দাও।
মেঘদূতম্ কাব্যে বর্ণিত অলকানগরীর বর্ণনা দাও ও কবি কালিদাসের বর্ণনা শক্তির পরিচয় দাও।
ভূমিকা:- সরস্বতীর বরপুত্র কালিদাসের লেখা মেঘদূত নামক গীতিকাব্যের উত্তর মেঘে অন্ধকার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা এককথায় অনিন্দ্য ও অবিস্মরনীয়। পূর্বমেঘে মেঘকে পথ চিনিয়ে কৈলাসের কোলে তাঁর স্বপ্নভূমি অলকায় উপনীত করেছেন মহাকবি কালিদাস ।
মেঘদূতম্ কাব্যে বর্ণিত অলকানগরীর বর্ণনা
অলকা দেবধনাধিপতি কুবেরের বাসভূমি যেখানে যক্ষপ্রিয়া তার বিরহ ব্রত উদযাপন করছে। হিমালয়ের কোলে উঁচু উঁচু সাততলা প্রাসাদে স্বচ্ছসলিলা গঙ্গায় শোভা পাচ্ছে অলকানগরী। মেঘ এবং অলকার প্রাসাদসমূহের সাদৃশ্য সহজেই নজরে পড়বে। কবির ভাষায়-
“বিদ্যুত্বন্তং ললিতবনিতাঃ সেন্দ্রচাপং সচিত্রাঃ।
সঙ্গীতায় প্রহতমুরজাঃ স্নিগ্ধগম্ভীরঘোষম্।
অন্তস্তোয়ং মনিময়ভূবস্তুঙ্গমভ্রংলিহাগ্রাঃ
প্রাসাদাস্ত্বাং তুলয়িতুমচলং যত্র তৈস্তৈর্বিশেষৈঃ।।”
মেঘে আছে বিদ্যুৎ- অলকায় আছে বিদ্যুল্লেখার মতো বনিতা। মেঘে শোভা পায় রামধনু- অলকার প্রাসাদে সুচারু চিত্রকর্ম। মেঘে গুরু গুরু ধ্বনি -অলকার প্রতি প্রাসাদে পাখোয়াজের বোল। মেঘে আছে জল-অলকার প্রাসাদের মনিময় ভিত্তি তার সঙ্গে স্পর্শ করে। মেঘ গগনচারী অলকার প্রাসাদগুলিও মেঘস্পর্শী। মেঘ আর অলকা- রঙে রসে এক। সবদিক দিয়েই পরস্পর তুলনীয়। তথাপি মেঘের মর্যাদা বেশি। এই অলকায় যক্ষবধূদের হাতে লীলাপদ্ম, কেশপাশে কুন্দকুঁড়ির মালা, লোধ্রফুলের রেণুতে তাদের মুখ পাণ্ডুবর্ণ, কবরীর দুই পাশে সদ্য ফোটা কুরুবকফুল, কানে শিরীষের ফুল এবং সিঁথিতে বর্ষাকালের কদমফুল। ছয় ঋতু এক সঙ্গে তাদের সম্ভার উজার করে দেয় এই অলকানগরীর বধূদের সাজাতে। এখানে সর্বদা সব ফুল ফোটে, আর ফুলের গন্ধে ভ্রমরেরা সবাই গুঞ্জন করে। দীঘিতে সারা বছর ধরে পদ্মের শোভা, হাঁসেরা সর্বদা দলবেঁধে সাঁতার কাটে। সারা বছরই ময়ূরেরা পেখম তুলে নৃত্য করে।
অলকায় কৃষ্ণপক্ষ না থাকায় প্রতি রাত্র জ্যোৎস্না মন্ডিত। এই অলকায় যক্ষদের চোখের জল কেবল আনন্দের কারণে। এখানকার যক্ষদের মদনজাত সন্তাপ প্রিয়জন সঙ্গমে নিবৃত্ত হয়, প্রণয় কলহ ভিন্ন অন্য কারণে এখানে কোন বিরহ ঘটে না, যৌবন ছাড়া এখানে অন্য কোনো বয়স নেই। বয়সের অস্তিত্ব আছে – তবে তার শুরু যৌবন দিয়ে, বয়সের বৃদ্ধি এখানে বার্ধক্য আনে না।
কবির ভাষায়-
” আনন্দোত্থং নয়নসলিলং যত্র নান্যৈর্নিমিত্তৈ-
র্নান্যস্তাপঃ কুসুমশরজাদিষ্টসংযোগসাধ্যাৎ।
নাপ্যন্যস্মাৎ প্রণয়কলহাদবিপ্রয়োগোপপত্তি-
-র্বিত্তেশানাং ন চ খলু বয়ো যৌবনাদ্যন্যদস্তি।।”
যক্ষরা এখানে সুন্দরীদের নিয়ে প্রাসাদের ছাদে কল্পবৃক্ষ থেকে পাওয়া রতিফল সুরা আকন্ঠ পান করে, মনিময় ছাদে নক্ষত্রের ছাদে নক্ষত্রের ছায়া পড়ে। মৃদঙ্গের ধীর গম্ভীর শব্দে পানভূমি মুখরিত থাকে।
অলংকার প্রবাহিত মন্দাকিনী নদী। তার তীরে অলকার যক্ষকন্যারা সোনারং বালুকায় মনি লুকিয়ে রেখে তা খুঁজে বার করার খেলায় মেতে থাকে। মন্দাকিনীর উপর দিয়ে বয়ে আসা শীতল বায়ু তাদের ক্লান্তি দূর করে। মন্দারবৃক্ষের ছায়া তাদের রৌদ্রতাপ থেকে রক্ষা করে। সুখের উপকরণের সম্ভাব এবং অসুখের কারণের অভাব দুয়ের সঙ্গমে এই অলকাভূমি সদা আনন্দময়। মিলনোৎসবের রাতে সুন্দরীরা লজ্জা নিবারণ করতে বৃথাই রত্নপ্রদীপের শিখায় মুঠো কুঙ্কুম নিক্ষেপ করে। বাতাসের ভর করে মেঘগুলি অলকার প্রাসাদের উপরের ঘরগুলিকে প্রবেশ করে নিজেদের জলকনায় সেইসব ঘরে রাখা ছবিগুলিকে নষ্ট করে। প্রথমে হয়তো তাদের এই ব্যাপারে খেয়াল হয় না, কিন্তু পরে তা বুঝতে পেরেই যেন ভয় পেয়ে ছোটো ছোটো মেঘখণ্ড প্রাসাদের গবাক্ষপথে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যায়। মিলনভূমিতে চাঁদোয়ার ঝালরে লাগানো চন্দ্রকান্ত মণিগুলি স্পষ্টভাবেই জলকনা বর্ষন করে এবং তাতে সম্ভোগের ক্লান্তি দূর হয়। অলকারকামী
অলকার কামী যক্ষদের গৃহে অক্ষয় সম্পদ। বিলাস ব্যসনে তাই তাদের অবধি অধিকার। অফুরান যৌবনের সুখভোগে যক্ষপুরুষরা বৈভ্রাজ উপবনে মিলিত হয় বারাঙ্গনা বধূদের নিয়ে। অলকাতে অভিসারিকারা রাতে সঙ্কেতগৃহে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলিত হতে যায় অভিসারিকাদের গমনপথ ভোরের আলোয় স্পষ্ট বোঝায় যায়। পথে ছড়িয়ে থাকে কামিনীদের অলক থেকে খসে পড়া মন্দার ফুল, কান থেকে খসে পড়া কর্ণকমল, বক্ষোদেশ থেকে খসে পড়া পত্রাবলীর চন্দনরেনু আর সূত্রহার। মদনদহনতাপে একমাত্র লক্ষ্যে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তারা ছোট।
কবির ভাষায়-
“গত্যুকম্পাদলকপতিতৈর্যত্র মন্দারপুষ্পৈঃ
পত্রচ্ছেদৈঃ কনককমলৈঃ কণবিভ্রংশিভিশ্চ।
মুক্তাজালৈঃ স্তনপরিসরচ্ছিন্নর্সূত্রেশ্চ হারৈঃ
নৈশো মার্গঃ সবিতুরুদয়ে সূচ্যতে কামিণীনাম্।।”
কুবেরের প্রাসাদের ঠিক উত্তরে যক্ষের গৃহ। গৃহের প্রবেশদ্বারে রামধনুর আকার ও বর্ণের বাহারে গড়া তোরণ। গৃহপ্রান্তে আছে যক্ষপত্নীর দ্বারা পুত্রস্নেহে বর্ধিত পুষ্পভারাবনত মন্দারতরু। কবির ভাষায়-
“তত্রাগারং ধনপতিগৃহানুত্তরেণাস্মদীয়ং
দুরাল্লক্ষ্যং সুরপতিধনুশ্চারুণা তোরনেন।
যস্যোপান্তে কৃতকতনয়ঃ কান্তয়া বর্ধিতো মে
হস্তপ্রাপ্যস্তবকনমিতো বালমন্দারবৃক্ষঃ।।”
যক্ষের গৃহে আছে একটি দীঘি। তার ঘাট বাঁধানো পান্নায়। বৈদূর্যমণি নালে সোনার পদ্মে সে দীঘি ভরে আছে। রাজহংসেরা এখানে বিচরণ করে। দীঘির তীরে কোমল ইন্দ্রনীল মণিতে নির্মিত শিখর এবং স্বর্ণময় কদলীতরুতে বেষ্টিত দর্শনীয় এক ক্রীড়াশৈল আছে। এই ক্রীড়াশৈল যক্ষ-যক্ষপত্নী দুয়েরই অনেক সুখস্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানেই কুরুবক গাছের বেড়ায় ঘেরা একটি মাধবী কুঞ্জ আছে। তাতে দুটি গাছ -রক্তাশোক ও বকুল। প্রথমটি যক্ষপত্নীর বামচরন প্রার্থী, দ্বিতীয়টি সুখমদিরা প্রত্যাশী। এই দুই গাছের মাঝে আছে সোনা আর স্ফটিকে তৈরি একটি দাঁড়ে দিনের শেষে নীলকন্ঠ ময়ূর এসে সেখানে বসলে যক্ষপত্নী হাতে তাল দিয়ে তাকে নাচায়। কবির ভাষায়-
“তন্মধ্যে চ স্ফটিকফলকা কাঞ্চনী বাসযষ্টি-
-র্মূলে বৃদ্ধা মনিভিরনতিপ্রৌঢবংশপ্রকাশৈঃ।
তালৈঃ শিঞ্জাবলয়সুভগৈর্নর্তিতঃ কান্তয়া মে
যামধ্যাস্তে দিবসবিগমে নীলকন্ঠঃ সুহৃদ্ বঃ।।”
যক্ষের গৃহের দুইপাশে আঁকা আছে শঙ্খ আর পদ্ম। যক্ষের বিরহে আজ তা দীপ্তিহীন।মেঘ এবারে জোনাকির মতো স্বল্প বিদ্যুতের আলো দিয়ে গবাক্ষ পথে যক্ষবধূকে দেখবে।
কবি কালিদাসের কৃতিত্ব / মূল্যায়ণ:-
এভাবে অলকার একটি রোমান্টিক ছবি এঁকেছেন যক্ষ। হয়তো তার পূর্ব স্মৃতির রোমান্থনের মধ্যে ভাবাবেগের বিহ্বলতা আছে, না পাওয়া দৈহিক চেতনার আক্ষেপ আছে এবং বিরহ যন্ত্রণা বিধুরতা আছে, কিন্তু বর্ণ চেতনায় এবং রূপকল্প নির্মাণের কুশলতায় প্রতিটি ছবি অনিন্দ্য সুন্দর একথা স্বীকার করতেই হবে।
কবি কালিদাসের বর্ণনা শক্তির পরিচয়
উর্ধ্বলোক ও নিম্নলোকের আপেক্ষিক অবস্থান কালিদাসের প্রিয় বিষয়। কুমারসম্ভবম্-এ পার্বতীর রূপপ্রদর্শন ও তপস্যা সাধণ, অভিজ্ঞানশকুন্তলম্– এ ইন্দ্রয়জ প্রেমের সঞ্চার ও স্বর্গীয় প্রেমের উদ্ভবের মতো মেঘদূতেও উজ্জয়িনী ও অলকার বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো।
অলকা অশেষ সুখের জায়গা, তাই অসাধারণ। কিন্তু সাধারণ জনের কপালে শুধু সুখ কোথায়। অলকা তাই অনেক দূরে। অলকা দুঃখের মুহূর্তে আমাদের হাতছানি দেয় মাত্র। কিন্তু তাকে ধরা যায় না। মানুষের অপূর্ণ কামনায় বিলাস অলকার সৌন্দর্য বর্ণনায় কালিদাসের কলমে যক্ষের মুখে রূপ পেয়েছে।
অলকায় বৈভবের প্রাচুর্যবশত উদাত্ত অলংকার দেখা যায়। সাহিত্যদর্পনে বিশ্বনাথ এই অলংকারের লক্ষণ নির্ণয় করেছেন-“লোকাতিশয়সম্পত্তিবর্ণনোদাত্তমুচ্যতে।”
- আরো পড়ুন – মেঘদূতে বর্ণিত যক্ষবধূর বর্ণনা