অপানিণীয় ব্যাকরণ চান্দ্র ব্যাকরণ সম্পর্কে যা জানো লেখ? চান্দ্র ব্যাকরণের রচয়িতা , সময়কাল বিষয়বস্তু ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হল ।
চান্দ্র ব্যাকরণ সম্পর্কে যা জানো লেখ
ভূমিকা:- অপানিণীয় ব্যাকরণ সম্প্রদায়গুলির মধ্যে চান্দ্র ব্যাকরণ সম্প্রদায়ের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। সংস্কৃত ব্যাকরণের ইতিহাসে যে, প্রসিদ্ধ নব ব্যাকরণের (৯ টি ব্যাকরণের) উল্লেখ আছে, তার মধ্যে চান্দ্র ব্যাকরণের নামও দেখা যায়-
” ঐন্দ্রং চান্দ্রং কাশকৃৎস্নং কৌমারং শাকটায়নম্।
সারস্বতং চাপিশলং শাকলং পানিণীয়কম্।।”
চান্দ্র ব্যাকরণের রচয়িতা
চান্দ্র ব্যাকরণের রচয়িতা হিসেবে কেউ চন্দ্রকে, কেউ চন্দ্রাচার্যকে, আবার কেউ বা চন্দ্রগোমীর নাম করে থাকেন। কেউ কেউ এই ব্যাকরণের কর্তাকে নিশাকর চন্দ্রের সঙ্গেও অভিন্ন করে দেখেছেন। যেমন – মহাভারত -এর অনুশাসন পর্বের একস্থানে (১৭/১৮) টীকাকার নীলকন্ঠ লিখেছেন – “নিশাকরচন্দ্রঃ চান্দ্রব্যাকরণপ্রণেতা”। নানা বিতর্ক থাকলেও এই চান্দ্র ব্যাকরণের রচয়িতা যেহেতু কোন বংশ পরিচয় সঠিকভাবে জানা যায় না, তাই এই সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। তবে আলোচনার জন্য আমরা অধিকাংশ পন্ডিতের মত অনুসরণ করেই চন্দ্রাচার্য নামটি ব্যবহার করতে পারি।
চন্দ্রাচার্যের সময়কাল
চন্দ্রাচার্যের সময়কাল সম্পর্কে বলা চলে যে, যদিও এ বিষয়ে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন, তবু মনে হয় বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বেশিরভাগ পন্ডিতগন চন্দ্রাচার্যকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের লোক বলেছেন।
চান্দ্রচার্যের পরিচয়
চান্দ্রচার্য একজন বৌদ্ধ বৈয়াকরণ ছিলেন। যদিও তার পূর্বে আরোও বৌদ্ধ বৈয়াকরণের কথা শোনা যায় এবং যদিও তাঁর পরবর্তীকালে ভাষাবৃত্তিকার পুরুষোত্তমদেব প্রমুখ বৌদ্ধ বৈয়াকরণের রচনা আমরা হাতে পেয়েছি। তবু বলা চলে যে, চন্দ্রাচার্য একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন এবং একটি শক্তিশালী ব্যাকরণ সম্প্রদায় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চান্দ্র ব্যাকরণের বিষয়বস্তু
বর্তমানে প্রাপ্ত চান্দ্র ব্যাকরণটিতে মোট ৬টি অধ্যায় আছে, প্রতিটি অধ্যায় আবার চারটি করে পাদে বিভক্ত এবং সমগ্র ব্যাকরণটিতে মোট ৩০৯৯ টি সূত্র আছে। অনেকে মনে করেন যে, হয়তো পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ীর মতো এখানেও বৈদিক ও স্বরপ্রক্রিয়া বিষয়ে আরও দুটি অধ্যায় ছিল। কারো কারো মতে, বৌদ্ধ হওয়ার কারণে হয়তো বৈদিক অংশ দুটি পরবর্তীকালে বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনটা ভাবার কারনও আছে।
যেহেতু এই ব্যাকরণের একটি সূত্রে বলা হয়েছে ” স্বরবিশেষমষ্টমে বক্ষ্যাম”, তাই মনে করা যেতে পারে যে, চান্দ্র ব্যাকরণ হয়তো অষ্টম অধ্যায় পর্যন্তই ছিল এবং অষ্টম অধ্যায়ে স্বর বিষয়ক আলোচনায় স্থান পেয়েছিল। চান্দ্র ব্যাকরণের প্রত্যাহার সূত্রগুলি পাণিনীর প্রত্যাহার সূত্রগুলিরই অনুরূপ। তবে চৌদ্দটি প্রত্যাহার সূত্রের পরিবর্তে এখানে তেরোটি প্রত্যাহার সূত্র করা হয়েছে। পাণিনীয় সম্প্রদায়ের ‘হযবরট্’ এবং লণ্ – এই দুটি প্রত্যাহার সূত্রের পরিবর্তে এখানে তেরোটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ চান্দ্র ব্যাকরণে ‘হযবরলণ্’ করায় এই ব্যাকরণে ১৩টি প্রত্যাহার সূত্র হয়েছে।
চান্দ্র ব্যাকরণের বৈশিষ্ট্য
আলোচনার বিষয়বস্তু ও বিষয়বিন্যাসের দিক দিয়ে চান্দ্র ব্যাকরণের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য মৌলিকতা না থাকলেও এই ব্যাকরণের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
যেমন-
- ক) সংজ্ঞা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অকৃত্রিম সরলতা দেখিয়েছে এই ব্যাকরন। বস্তুত এই ব্যাকরণে একদিকে যেমন কৃত্তিম সংজ্ঞা পরিহারের চেষ্টা করা হয়েছে, তেমনি অন্বর্থ সংজ্ঞার ও ব্যবহার যথাসম্ভব সংকুচিত করা হয়েছে। যেমন – সর্বনাম সংজ্ঞার পরিবর্তে সর্বাদি, প্রতিপাদিক স্থলে শব্দ সংজ্ঞার ব্যবহার প্রভৃতি।
- খ) এই ব্যাকরণ রচনার উদ্দেশ্যে বলতে গিয়ে চন্দ্রাচার্য নিজেই বলেছেন – “লঘু-বিস্পষ্ট- সম্পূর্ণমুচ্যতে শব্দলক্ষণম্”।অর্থাৎ বোঝা গেল যে, লঘুতা, স্পষ্টতা এবং পূর্ণতার দিকেই বৈয়াকরণ এর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। মনে হয় পাণিনী ব্যাকরণের দূরুহাতা ও অতিপরিস্থিতি দেখে এবং কাতন্ত্রাদি ব্যাকরণের অসম্পূর্ণতা দেখেই চন্দ্রাচার্য এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
- গ) চান্দ্রবৃত্তি এবং বামনিয়া লিঙ্গানুশাসনবৃত্তিতে ‘চান্দ্রব্যাকরণ’ সম্পর্কে বলা হয়েছে “চন্দ্রোপজ্ঞমসংজ্ঞকং ব্যাকরণম্”। আমাদের মনে হয় এখানে ওই পারিভাষিক বা কৃত্তিম সংজ্ঞা পরিহারের কথাই বলা হয়েছে।
- ঘ) এছাড়া পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ী ও পতঞ্জলির মহাভাষ্যের প্রভাবের কথা তো আগেই বলা হয়েছে।
চন্দ্রাচার্যের অন্যান্য রচনা
নিজের ব্যাকরণের সম্পূর্ণতা সাধনের জন্য চন্দ্রাচার্য সূত্র পাঠের অনুষঙ্গিক বৃত্তি, ধাতু পাঠ, গণপাঠ, উনাদিপাঠ এবং লিঙ্গানুশাসনও রচনা করেছিলেন। শুধু তাই নয় এছাড়াও তিনি উপসর্গ বৃত্তি, শব্দকোষ প্রভৃতিও রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।
চান্দ্র ব্যাকরণের সম্পাদনা ও প্রকাশনা
জার্মানির বিখ্যাত পন্ডিত ডক্টর ব্রুনো লিবিশ চান্দ্র ব্যাকরন সূত্র ও বৃত্তি প্রথম সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পরে ডক্টর ক্ষিতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনাতেও বৃত্তিসহ চান্দ্র ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়।
চান্দ্র ব্যাকরণের মূল্যায়ন
কাশিকাবৃত্তির ওপর চান্দ্রব্যাকরনের প্রভাব নিয়ে কিছু কিছু গবেষণা নিবন্ধ রচিত হয়েছে, এছাড়াও চান্দ্রবৃত্তি, চান্দ্রগণপাঠ, চান্দ্রলিঙ্গানুশাসন প্রভৃতি নিয়েও এই যুগের গবেষকগণ গবেষণা করেছেন। এসব থেকে বোঝা যায় যে, চান্দ্রব্যাকরণ পরবর্তীকালের বৈয়াকরণগনের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।