বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাসে অথর্ববেদ সম্পর্কে আলোচনা । বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাসে অথর্ববেদ বিশিষ্ট স্থান ও অথর্ববেদের মন্ত্রগুলির শ্রেণী বিভাগ করা হল।
অথর্ববেদ সম্পর্কে আলোচনা কর
উ:- বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাসে অথর্ববেদ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। অথর্ব বেদের প্রাচীন নাম অথর্বাঙ্গিরস। অথর্বন শব্দের অর্থ হল -এক শ্রেনীর অগ্নির উপাসক। অঙ্গিরা শব্দের অর্থ হল অগ্নিযাজক। প্রাচীনকালে অথর্বনদের লোকে ইন্দ্রজাল বিদ্যায় পারদর্শী বলে মনে করতেন এবং রিষ্টি, শান্তি, ব্যাধি নিরাময়, অনাবৃষ্টি নিবারণের ক্ষেত্রে তাদের সাহায্যে প্রার্থনা করা হত। এই শুভজনক অথর্বন ও অশুভজনক অঙ্গিরস উভয় বিদ্যাই যে বেদে লক্ষ্য করা যায় তাকে অথর্ববেদ বলে।
এই প্রসঙ্গে ভিন্টারনিৎস বলেছেন-
“The old name Atharvangirasah means to kinds of magic formula which from the chief man tents of the Atharvaveda. “
অথর্ববেদের ২০টি কান্ড, ৩৮ টি প্রপাঠক ৯০টি অনুবাক, ৭৩১ টি সূক্ত এবং প্রায় ৬০০০ মন্ত্র বিদ্যমান। গদ্য ও পদ্য উভয় প্রকার মন্ত্রই এখানে পাওয়া যায়। আচার্য সায়ন অথর্ব বেদের ভাষ্য ভূমিকায় ৯ টি শাখার উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে এই বেদের দুটি শাখা পাওয়া যায়।- শৌনকীয় ও পৈপ্পলাদ। আচার্য সায়ণ অন্যান্য বেদকে শুধু আয়ুস্মিক ফলপ্রদ বলেছেন কিন্তু অথর্ব বেদকে ঐহ্যিক ও আয়ুস্মিক উভয় ফলপ্রদ বলেছেন-
” ব্যাখ্যায় বেদাত্র তয়মায়ুস্মিক ফলপ্রদম্
ঐহিকায়ুস্মিক ফলং চতুর্থং বাক্যরিচ্যতে।।”
অথর্ববেদ, বেদ পর্যায়ভুক্ত কিনা এ বিষয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বেদকে ত্রয়ী বলা হয়েছে। অনেকে আবার ত্রয়ী বলেছেন শুধুমাত্র ঋক, সাম ও যজু এই তিনটি বেদকে। অপরদিকে কিছু পণ্ডিতগণের মন্তব্য অথর্ববেদের মন্ত্র এই তিন প্রকার মন্ত্রেরই লক্ষণাক্রান্ত। সুতরাং অথর্ববেদকে ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত না করায় কোন কারণ নেই। মুণ্ডকোপনিষদেও একত্রে চারপ্রকার বেদের নাম পাওয়া যায়-
” তত্রা পরা ঋগ্বেদে যজুর্বেদঃ সামবেদোঅথর্ববেদঃ।”
অথর্ববেদের মন্ত্রগুলির শ্রেণী বিভাগ
বিষয়বস্তুর দিক থেকে অথর্ববেদের মন্ত্রগুলিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-
- i)ভৈষজ্য মন্ত্র,
- ii) আয়ুষ্য মন্ত্র,
- iii) পৌষ্টিক মন্ত্র,
- iv) প্রায়শ্চিত্ত মন্ত্র,
- v) কামনাপূর্তির মন্ত্র,
- vi) অভিচার মন্ত্র এবং
- vii) সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক মন্ত্র ইত্যাদি।
অথর্ববেদের ঋষিরা রোগব্যাধির আড়ালে বিশেষ জ্বরা, অসুরের কল্পনা করে মন্ত্রশক্তির সাহায্যে তাকে দূর করতে চেয়েছেন-
” অয়ং যো বিশ্বান্ হরিতান্ কৃণোষ্যুচ্ছোচয়ণগ্নিগিরি বা ভিদুম্বন্।
অধা হি তরামন্নর সো হি ভূয়া অধান্যঙ্ ভূধরাং বা পরেহি।।”
i) ভৈষজ্যমন্ত্র :-
অসুর পিশাচ বা রাক্ষসেরা জ্বরের মূল কারণ। এরূপ বিশ্বাস সেই সময় প্রচলিত ছিল। এদের প্রভাব থেকে জনপদকে রক্ষা করার জন্য অনেক মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। এই মন্ত্রে রাক্ষসের অশুভ শক্তিতে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে-
” তপনো অস্মি পিশাচানাং ব্যাঘ্রোগোমতামিব।।”
ii) আয়ুষ্য মন্ত্র:-
দীর্ঘ নীরোগ জীবন এবং সুন্দর স্বাস্থ্য লাভের জন্য আয়ুষ্য মন্ত্রের প্রয়োগ করা হত। এইরূপ একটি মন্ত্রে দ্যুলোক ও পৃথিবীলোকের মত প্রাণকে অভয়দান করে বলা হয়েছে-
” যথা দ্যৌশ্চ পৃথিবী চ ণ বিভীতো ণ রিষ্যতঃ এবা মে প্রাণ মা বিভেঃ।।”
iii) প্রায়শ্চিত্ত মন্ত্র:-
মানুষ জ্ঞাত ও অজ্ঞাত সারে পাপ করে থাকেন। সেই পাপ থেকে রক্ষার জন্য পায়শ্চিত্তের উল্লেখ আছে। এছাড়াও পারিবারিক অশান্তি ও মনোমালিন্য দূর করার জন্য অথর্ববেদে আর এক প্রকার মন্ত্র প্রযুক্ত হত।
” অনুব্রতঃ পিতুঃ পুত্রো মাতা ভবতু সংমনাঃ।
জায়া পত্যে মধুমতীং বাচ্যং বদতুশান্তিবাম্।।”
iv) পৌষ্টিক মন্ত্র:-
খুব সমৃদ্ধি ও কর্মে সাফল্যের জন্য নানা মন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। পৌষ্টিক মন্ত্রসমূহের বিষয়বস্তুগুলি হল কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য এছাড়াও গৃহ নির্মাণে সকল প্রকার বিঘ্নের নিরসন এবং আকস্মিক উৎপাতের হাত থেকে নিকৃষ্ট লাভ। অথর্ববেদে সংহিতার বিভিন্ন শ্লোকে সেই কামনা প্রকাশিত হয়েছে।
v) কামনাপূর্তির মন্ত্র বা স্ত্রীকর্মজনিত মন্ত্র:-
অথর্ববেদের চতুর্দশ কাণ্ডে মনোমত পতিলাভ, সুখপ্রসব, গর্ভরক্ষা, পুত্রলাভ, স্বামীর ক্রোধ, উপশম, অন্য নারীতে পতির আসক্তি দূর করার জন্য এমনকি অভীষ্ট পুরুষকে বসে আনার জন্য কিছু মন্ত্র পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে কোন অনিচ্ছুক রমণীর হৃদয়কে কামবানে বৃদ্ধ করে তাকে পুরুষের প্রতি আসক্ত করার জন্য একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে-
” উত্তুদস্ত্বোৎ তুদতু মা ধৃতাঃ শয়ণে স্বে ইষুঃ কামস্য যা ভীমা তয়া বিধ্যামিত্বাহৃদি।।”
vi) অভিচার মন্ত্র:-
এই মন্ত্র গুলো শত্রু নিধনের উপযোগী। শত্রু সর্প ভূত প্রেতাদির উপদ্রব নিবারনের জন্য বিভিন্ন কার্যে এই মন্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
vii) সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক মন্ত্র:-
সৃষ্টিরহস্য, দার্শনিক তত্ত্ব সমন্বিত অনেক সূক্ত আছে যেখানে ব্রহ্মতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।
এছাড়াও অথর্ববেদে আরও কতগুলি সূক্ত আছে যেগুলির কাব্যিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। যেমন- ভূমি সূক্ত, বৃষ্টি সূক্ত প্রভৃতি।
বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাসে অথর্ববেদের স্থান
বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাসে অথর্ববেদ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। প্রাচীন আর্যদের রীতিনীতি, ভাবধারা, তদানীন্তন ভারতীয় লোকসংস্কৃতি, জানার পক্ষে অথর্ববেদ এক মূল্যবান দলিল। চিকিৎসা, আয়ুর্বেদ, তন্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্রের ইতিহাসেও অথর্বেদের অবদান বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। এমনকি তারা মনে করতেন যে, যে রাজ্যে অথর্ববেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বাস করতেন সেই রাজ্যে কখনো উপদ্রব দেখা দেবে না –
“যস্য রাজ্ঞো জনপদে অথর্বা শান্তি পারগঃ।
নিবসত্যপি তদ্ রাষ্ট্রং বর্ধতে নিরূপদ্রবম্।।”
এর থেকে অনুমান করা যায় যে, অন্যান্য বেদে তুলনায় অথর্ববেদ যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল।
অথর্বণীদের বেদ অথর্ববেদ। অথর্বণ নির্দেশাবলী এবং মন্ত্রগুলিকে নির্দেশ করে বিশেষ করে মন্দ এবং কষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য এবং এতে দার্শনিক চিন্তাভাবনাও রয়েছে । ‘অথর্বণ’ এর প্রকৃত অর্থ ‘পুরোহিত’ এবং অথর্ববেদ-সংহিতার মন্ত্রগুলি ঋষি অথর্ব দ্বারা আলোকিত হয়েছিল।
এটি স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়তা করে, এটি রোগগুলি, তাদের কারণগুলি বুঝতে এবং তাদের নিরাময়, দীর্ঘায়ু ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত করতেও সহায়তা করে।