আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কি ? প্রাচীন ভারতে আয়ুর্বেদ চর্চার পরিচয় দাও অথবা প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্র pdf দেওয়া হল। প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা । প্রাচীন ভারতে আয়ুর্বেদের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা ।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কি? প্রাচীন ভারতে আয়ুর্বেদ চর্চার পরিচয় দাও
প্রাচীন ভারতবর্ষে জ্ঞানের সর্ববিধ শাখার অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছিল। কাব্যের পরিধি থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান সংক্রান্ত বা অন্যান্য বিদ্যার পরিধি লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শাস্ত্রের শাখাগুলির মধ্যে আছে আয়ুর্বেদ, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, রসায়নবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, রত্নবিদ্যা, ভূগোল, কৃষি, সঙ্গীত,প্রসাধন,পাকশাস্ত্র এবং আরও অনেক কিছু।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কি
আয়ুর্বেদ শব্দের মধ্যে দুটি পদ আছে- আয়ু ও বেদ। অর্থ জীবনের বিজ্ঞান। আয়ুর্বেদ পঞ্চম বেদ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এর জন্মও যুগযুগব্যাপী বিকাশ এই ভারতেই হয়েছে। কোন এক প্রাচীনকালে হিমালয়ের পাদদেশে ঋষিদের এক মহাসম্মেলনে আয়ুর্বেদের সৃষ্টি হয়েছিল। মহর্ষি আত্রেয়র সভাপতিত্বে তাঁর ছয়জন শিষ্য ছয়টি আয়ুর্বেদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাই আয়ুর্বেদকে নিত্য ও অপৌরুষেয় বলা হলেও আয়ুর্বেদ গ্রন্থগুলি পৌরষেয়।
প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদাচার্য
আত্রেয় ছাড়া ভারদ্বাজ, অগ্নিবেশ, হারীত, ধন্বন্তরি প্রমুখ আয়ুর্বেদাচার্যের নামও বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। বেদে সূর্য, রুদ্র,শিব, ব্রহ্মা, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের নাম রোগ নিরাময়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের অশ্বিনীসংহিতা, নাড়ীনিদান; শিবের কৈলাশকারক, বৈদ্যরাজতন্ত্র, শৈবসিদ্ধান্ত ; কার্তিকের বাহটসংহিতা ইত্যাদি গ্রন্থের নাম আছে। বেদে বিশেষত অথর্ববেদে ভৈষজ্যসূক্ত প্রাচীনতম চিকিৎসাগ্রন্থরূপে মর্যাদাপ্রাপ্ত।
প্রাচীন ভারতে আয়ুর্বেদের উদ্ভব
ভারতের অসংখ্য গাছপালার বিভিন্ন অংশের স্বাদ, গন্ধ,বিক্রিয়ার জ্ঞান কিভাবে চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায় তার নির্দেশ আছে এখানে। কালক্রমে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদের উদ্ভব হয়। এই আটটি অঙ্গের পরিচয় ও এই এই বিষয়ে রচিত গ্রন্থের নাম হল-
১) কায়চিকিৎসা
পরিপাক ও বিপাক ক্রিয়ার সমস্যা থেকে জাত রোগ যেমন জ্বর অতিসার মেহ ইত্যাদির চিকিৎসা। গ্রন্থ-ভেলসংহিতা, জতুকর্ণসংহিতা, নাগার্জুনের যোগসার, চক্রপাণির চিকিৎসারসংগ্রহ, ভাবমল্লের ভাবপ্রকাশ ইত্যাদি।
২) শালাক্যতন্ত্র
মুখমন্ডলের রোগের চিকিৎসা। যেমন বিধেয়তন্ত্র, নিমিতন্ত্র, কাত্যায়নতন্ত্র।
৩) শল্যতন্ত্র
অস্ত্রোপচার। যেমন ভোজতন্ত্র, ভানুকীতন্ত্র,কপিলতন্ত্র।
৪) অগদতন্ত্র
প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বিষে সংঘটিত রোগের চিকিৎসা।
৫) ভূতবিদ্যা
মনের চিকিৎসা হল ভূতবিদ্যা ।
৬) কুমারভৃত্য
শিশুচিকিৎসা। যেমন রাবণের কুমারভৃত্য, অজ্ঞাত কারও বালচিকিৎসা।
৭) রসায়ন
যৌবনধারকবিদ্যা। যেমন -কুচুমার তন্ত্র।
৮) বাজীকরণ
বংশরক্ষা সম্পর্কিত চিকিৎসা।
দাহবাহিসংহিতা ও কাশ্যপসংহিতায় অন্য অঙ্গগুলির আলোচনা আছে।
প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্র
আচার্য দের মতামত সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কিছু সংকলন গ্রন্থের উদ্ভব হয়। চরক সংহিতা, সুশ্রুতসংহিতা ও বাগভট্টের অষ্টাঙ্গ হৃদয় সংহিতা এই তিনটিকে একত্রে আয়ুর্বেদের বৃহৎত্রয়ী বলা হয়।
১) চরক সংহিতা
আনুমানিক প্রথম শতকে রচিত প্রাচীনতম ও সমৃদ্ধতম গ্রন্থ। আত্রেয়র শিষ্য অগ্নিবেশ প্রথমে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। পরে চরক ও দৃঢ়বল দুবার সম্পাদনা করেন। গ্রন্থটি আটটি স্থানে বিভক্ত – সূত্র, নিদান, বিমান, শরীর,ইন্দ্রিয়,চিকিৎসা,কল্প ও সিদ্ধি। এগুলি কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত। গ্রন্থে মোট অধ্যায়ের সংখ্যা ১২০। মানুষের শারীরিক মানসিক তথা সর্ববিধ কল্যাণের জন্য ও দীর্ঘ জীবন লাভের অভিপ্রায়ে এই মহান গ্রন্থ রচনা হয়। রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ দুই বিষয়েই এখানে আলোচনা আছে। এটি প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের তত্ত্ব দর্শন রোগ ও আরোগ্য বিষয়ক সম্পূর্ণাঙ্গ অনবদ্য রচনা।
মোট ৪৩ টি টিকা গ্রন্থ এর আছে।যেমন ভট্টার হরিশচন্দ্রের চরকন্যাস, স্বামীকুমারের চরকপঞ্জিকা, চক্রপাণি দত্তের আয়ুর্বেদদীপিকা।
- বিশদে পড়ুন – চরকসংহিতা ( Charaksanghita ) টীকা
২) সুশ্রুত সংহিতা
ধন্বন্তরি প্রবর্তিত সম্প্রদায়ের সংকলন আনুমানিক ৫ম শতকে রচিত ও নাগার্জুনের সম্পাদিত। এর ৬টি অধ্যায় – সূত্র, নিদান, শারীর, চিকিৎসা, কল্প ও উত্তর। শল্যপ্রক্রিয়ার ৭টি ভেদ – ছেদন, ভেদন, লেখন, ত্রয্যন, আহরণ বিস্রবণ, সীবন। প্লাস্টিক সার্জারির আলোচনাও এখানে আছে। টিকা লিখেছেন জৈয়ট গয়দাস প্রমুখ।
- বিশদে পড়ুন – সুশ্রুত সংহিতার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে বর্ণনা
৩) অষ্টাঙ্গহৃদয় সংহিতা
আনুমানিক ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধ বাগভট্ট রচিত এই গ্রন্থে আট অঙ্গের আলোচনা আছে। অরুণদত্ত, হেমাদ্রি এর টীকা লিখেছেন।
এছাড়াও চিকিৎসাশাস্ত্রের পৃথকভাবে বিভিন্ন শাখায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যেমন-
- ১. শারীরতত্ত্বঃ- ভাস্করভটের শারীরপদ্মিনী।
- ২. নিদানঃ- মাধবের মাধবনিদান।
- ৩. ভৈষজ্যতত্ত্বঃ- রাজবল্লভের দ্রব্যগুণ।
- ৪. পথ্যতত্ত্বঃ- সুষেণের অন্নপানবিধি।
- ৫. নাড়ীবিজ্ঞানঃ- কণাদের নাড়ীবিজ্ঞান।
- ৬. পশুচিকিৎসাঃ- নীলকণ্ঠের মাতঙ্গলীলা।
সব মিলিয়ে আমরা দেখি যে রোগপূর্ব সাবধানতা ও রোগোত্তর চিকিৎসা দুই বিষয়েই প্রাচীন ঋষিতুল্য চিকিৎসকরা অজস্র গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যা তথাকথিত কাব্যচর্চার পাশাপাশি ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ধারাকেও অক্ষুণ্ন রেখেছিল।
আরো পড়ুন